ডা. যোবায়দা হান্নানের জন্মদিন আজ

নিজস্ব প্রতিবেদক
Thumbnail image

সময়টা ছিলো ২০১০ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি। কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেঝেতে পড়ে আছে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী এক কিশোরী। ওর মুখ দিয়ে লালা গড়িয়ে পড়ছে। গায়ের জামা কাপড় নোংরা। গোসল নেই অনেকদিন। ঝাপসাভাবে নিজের নামটা কেবল বলতে পারে। সঙ্গে নেই কোন মানুষ। শারমিন আক্তার নামের ১৪ বছর বয়সী ওই কিশোরীকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ উদ্ধার করে সেবা দেয়। এরপর তাঁরা সমাজসেবা অধিদপ্তরে শারমিনের পুনর্বাসনের জন্য যোগাযোগ করে। সমাজসেবা অধিদপ্তর তাঁদের কোন ব্যবস্থা নেই বলে দায় এড়িয়ে যায়। খবর পেয়ে চিকিৎসক যোবায়দা হান্নান হাসপাতালে ছুটে যান। তিনি ওই কিশোরীকে তাঁর বাসায় নিয়ে আসেন। এরপর তাঁকে নতুন জামাকাপড় কিনে দেন। পরম মমতায় নিজের বাসায় রেখে লালনপালন করেন। মাস দু'য়েক পর ওই কিশোরীকে ঢাকার একটি পুনর্বাসন কেন্দ্রে পাঠান। এ জন্য প্রতিমাসে তিনি দুই হাজার টাকা খরচ বহন করে আসছিলেন। কেবল শারমিন নয়, এ রকম অসহায় নারী ও শিশুদের আশ্রয়দাতা হিসেবে যোবায়দা হান্নানের পরিচিতি ছিলো কুমিল্লা ছাড়িয়ে দেশের সবখানেই।

বলছিলাম, কুমিল্লা অঞ্চলের প্রথম নারী ধাত্রীবিদ্যা বিশেষজ্ঞ যোবায়দা হান্নানের কথা। আজ ১৪ নভেম্বর তাঁর জন্মদিন। জন্মদিনে তাঁকে জানাই ফুলেল শুভেচ্ছা। মৃত্যুর ১৪ বছর পরেও তিনি আমাদের হৃদয়ে আছেন। বেঁচে থাকলে আজ তাঁর বয়স হতো ৮০ বছর।

ডা. যোবায়দা হান্নান নারীদের চিকিৎসা করতে গিয়ে তাঁদের ভেতরের খবর সংগ্রহ করতেন। পারিবারিক নির্যাতন, নারীর প্রতি সহিংসতা নিয়ে তিনি কুমিল্লায় সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। তাঁর কাজের পরিধি অনেক বড়। চিকিৎসা সেবার বাইরে এসে তিনি হয়ে ওঠেন অনন্য এক ব্যক্তিত্ব হিসেবে। তিনি স্বামীর বাড়ি কুমিল্লার নাঙ্গলকোটের আশারকোটা গ্রামকে স্বনির্ভর করার জন্য আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। সুবিধাবঞ্চিত ও উপেক্ষিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। গ্রামের মেয়েদের শিক্ষিত করার জন্য নাঙ্গলকোটে ডা. যোবায়দা হান্নান মহিলা স্কুল ও কলেজ স্থাপন করেন। তাঁর নিজ অর্থায়নে ১৯৮৫ সাল থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত কলেজটি পরিচালিত হয়। এরপর প্রতিষ্ঠানটি এমপিওভুক্ত হয়। তাঁর দৃঢ় নেতৃত্ব ও উদ্যমী প্রচেষ্টার কারণে কুমিল্লায় দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ডায়াবেটিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা হয়। গরিব জনগণের দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে আনার জন্য আলেখারচরে গড়ে তোলেন চক্ষু হাসপাতাল। কারাগারে বিভিন্ন অপরাধে অভিযুক্ত নারী ও শিশুদের দ্রুত বিচারের মাধ্যমে শাস্তি ভোগের পর সমাজে প্রতিষ্ঠা করার জন্য তিনি গড়ে তোলেন সামাজিক ও পুনরুদ্ধার সংশোধন সমিতি। তালাক প্রাপ্ত, বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্তা মহিলাদের কর্মসংস্থানের জন্য গড়ে তোলেন আপন ঘর নামের হস্তশিল্প সংগঠন। দেশকে জনসংখ্যা বিস্ফোরণের হাত থেকে রক্ষার জন্য তিনি রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করেন। দাম্পত্য কলহে মহিলাদের অহেতুক তালাক প্রতিরোধের জন্য বিচারপ্রাপ্তিতে সহায়তা করতেন তিনি। এ জন্য নারীদীপিতা নামের সংগঠন গড়ে তোলেন। প্রায় অর্ধ শতাধিক প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তার সঙ্গে তাঁর নাম কিংবদন্তী হিসেবে রয়েছে। তাঁর ইংরেজি উচ্চারণ ও লেখা তরুণ প্রজন্মের কাছে আদর্শ।

কুমিল্লাবাসীর কাছে তিনি 'খালা', 'আপা' নামেই সবচেয়ে বেশি সমাদৃত। মানুষকে তিনি খুব সহজেই আপন করে নিতেন। তাঁর 'তুই' সম্বোধন যে কাউকেই মন ভুলিয়ে দিতো। অতিথি আপ্যায়নে তাঁর জুড়ি নেই। প্রতিদিন ১৮ ঘণ্টা কাজ করে তিনি প্রমাণ করেছেন মানুষ মানুষের জন্য।

যোবায়দা হান্নান কেবল একটি নামই নয়, একটি প্রতিষ্ঠান । জীবনের নানা সমীকরণের মধ্যেও তিনি কাজ পাগল ছিলেন। মানুষের মধ্যে থাকতে তিনি পছন্দ করতেন। সাধারণ অথচ অসাধারণ গুণ নিয়েই তাঁর ৬৬ বছরের কর্মময় জীবন। তিনি আমেরিকার ওয়াশিংটন, নেপাল, ভারত, মালয়েশিয়া, লন্ডন, নিউইয়র্ক, জাপান, সৌদিআরবসহ বিভিন্ন দেশে আন্তর্জাতিক সেমিনারে যোগদান করেন।

তাঁর ওই কাজের স্বীকৃতি দিয়েছে বাংলাদেশ সরকারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। ২০০৪ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে নিয়েছেন একুশে পদক। ১৯৯৫ সালে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক পেয়েছেন জাতীয় অধ্যাপক মো. ইব্রাহীম পুরস্কার। ১৯৯৬ সালে লাভ করেন ত্রিরত্ন পুরস্কার, ১৯৯৭ সালে পান জাতীয় সমাজসেবা পুরস্কার। ২০০৬ সালের মার্চ মাসে অনন্যা শীর্ষ ১০ নারী পদক পান।

বিশিষ্ট চিকিৎসক যোবায়দা হান্নান ১৯৪৫ সালের ১৪ নভেম্বর চট্টগ্রামের মিরসরাইতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা মাহফুজুল হক পাকিস্তান সরকারের কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা ও সমাজকল্যাণমন্ত্রী ছিলেন। যোবায়দা হান্নানের স্বামী বিশিষ্ট চিকিৎসক ও কুমিল্লা ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি এম ওয়ালী উল্লাহ ।

অসাধারণ ব্যক্তিত্ব, সুজনী প্রতিভা, মেধা ও যোগ্যতার যোবায়দা হান্নান নেই। কিন্তু তাঁর প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান কুমিল্লায় রয়েছে। ডায়াবেটিস রোগীদের সেবার জন্য তাঁর উদ্যোগ প্রজন্মের পর প্রজন্ম মনে রাখবে। তিনি কুমিল্লা ডায়াবেটিক হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা। গরিব অসহায় চক্ষু রোগীদের বিনামূল্যে সেবা প্রদান তাঁর পরম ধর্ম ছিলো।

কুমিল্লার বিশিষ্ট নারীনেত্রী দিলনাশি মোহসেন বলেন, ডা. যোবায়দা হান্নান আমাদের বাতিঘর। তিনি ঘরোয়াভাবে জন্মদিন পালন করতেন। তাঁকে এখনও স্মরণ করি কাজে। চলাফেরায়। তিনি আমাদের হৃদয়ে আছেন।

বিষয়:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

সম্পর্কিত