আবদুল্লাহ আল মারুফ
প্রতিষ্ঠার পর থেকে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি করে রেকর্ড গড়েছে কুমিল্লা ইপিজেড। গত ২৪-২৫ অর্থ বছরে দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার মাঝেও ৯০২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার রপ্তানি করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
কুমিল্লা ইপিজেড সূত্রে জানা গেছে, দক্ষিণ চর্থা এলাকায় ২০০০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় কুমিল্লা ইপিজেড। এখানে ৪৮টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। যেখানে কর্মরত আছেন ৫০ হাজারের বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারী। গত তিন অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি করেছে দুই হাজার ৯৩৩ দশমিক ৬৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। তবে ২০২১ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত রপ্তানি না বেড়ে কমে গিয়েছিল। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৮১৪ দশমিক ৮২ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৭৯০ দশমিক ৯৫ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৭১১ দশমিক ৩৭ মিলিয়ন ডলারের পণ্য যায়।
৫০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান
কুমিল্লা ইপিজেডের দেয়া তথ্য মতে, বর্তমানে কুমিল্লা ইপিজেডে ৪৬টি শিল্প প্রতিষ্ঠান উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনা করছে এবং ৬টি প্রতিষ্ঠান বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। কুমিল্লা ইপিজেডে বিনিয়োগকৃত শিল্প প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৩১টি সম্পূর্ণ বিদেশি, আট দেশি বিদেশি যৌথ-উদ্যোগ এবং ১৩টি সম্পূর্ণ বাংলাদেশি মালিকানাধীন শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কুমিল্লা ইপিজেডের শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহে এখন পর্যন্ত প্রায় ৬১৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে। যেখানে প্রতিদিন ৫০ হাজারেরও বেশী স্থানীয় জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান হয়েছে।
স্বাবলম্বী হচ্ছেন নারীরাও
কুমিল্লা ইপিজেডে কর্মরত শ্রমিক কর্মচারীদের মধ্যে ৬৬শতাংশই নারী, যা অত্র অঞ্চলের নারীর ক্ষমতায়নের পাশাপাশি গ্রামীণ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। অনেক স্বামী পরিত্যক্তা নারী এই ইপিজেডে কাজ করেই তাদের ভাগ্য বদলেছেন। যার একটি বড় অংশ পরিবারের একমাত্র উপার্যনক্ষম নারী।
তাদের একজন কুমিল্লার নাঙ্গলকোট উপজেলার মাহীনি এলাকার মনোয়ারা বেগম। দুই সন্তান রেখে স্বামীর চলে যাওয়ার পর তিনি হাল ধরেছেন। দুই সন্তান পড়ালেখা করেন। আর মনোয়ারা এখন ইপিজেডের একজন দক্ষকর্মী। তিনি শহরে থাকলেও সন্তানরা গ্রামে পড়াশোনা করেন।
মনোয়ারার বেগম বলেন, কীভাবে সংসার চালাবো তাই ভাবছিলাম। স্বামী ছেড়ে যাওয়ার পর পাশের এলাকার একজন নারী কর্মী আমাকে এখানে নিয়ে আসে। এখন ভালোই চলছে সব।
স্থানীয় অর্থনীতিতে যেভাবে ভূমিকা রাখছে
প্রতিমাসে শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাবদ প্রায় ২৫০ কোটি টাকা ব্যয় করে থাকে। এছাড়া কুমিল্লা ইপিজেডে কর্মরত প্রায় ২৭০ জন বিদেশি কর্মী কুমিল্লা শহরের বিভিন্ন এলাকায় বসবাস করে। যারা কুমিল্লা ইপিজেড সংলগ্ন এলাকায় থাকেন। এতে করে একেবারে বদলে গেছে এই এলাকার অর্থনীতি। গড়ে উঠেছে নতুন বাজার। তৈরি হয়েছে আরও কয়েক হাজার কর্মসংস্থান। বেড়েছে এই এলাকার বাসাবাড়ির ভাড়া। যেন এক নতুন অর্থনৈতিক নগরী।
জানা গেছে, ইপিজেডের কোন বিনিয়োগকারী তাদের মোট আয়ের প্রায় ৮০ শতাংশ শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, ভাড়া ও ইউটিলিটি চার্জ, প্রতিষ্ঠানের কর্মরত বিদেশি নাগরিকদের জীবন ব্যয় এবং অন্যান্য পরিচালনাগত ব্যয় বাবদ খরচ করে যা স্থানীয় অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার পাশাপাশি সার্কুলার অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। ইপিজেডকে কেন্দ্র করে আবাসন, পরিবহন, রেস্টুরেন্ট, নির্মাণ শিল্প ও প্রতিষ্ঠানসহ ইপিজেডে সরবরাহের লক্ষ্যে বেকওয়ার্ড লিংকেজ ইন্ডাস্ট্রি তৈরি হয়েছে যার মাধ্যমে অত্র অঞ্চলের মানুষের জীবিকার অন্যতম উপজীব্য এই ইপিজেডকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হচ্ছে এবং সামষ্টিক অর্থনীতির বিকাশের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভমিকা পালন করছে।
ইপিজেড এলাকার ইয়াছিন মাকের্টের স্ট্রিট ফুড বিক্রেতা জেলার সদর উপজেলার ইব্রাহীম খলিল বলেন, আগে প্রবাসে ছিলাম। কিছু করতে পারিনি। ঋণ নিয়ে বাড়ি চলে এসেছি। প্রতি সন্ধ্যা ও বিকেলে এই এলাকায় চাপ, মাসালা এগুলো বিক্রি করি। এখন আর চিন্তা নেই। মাসে ৪০-৪৫ হাজার টাকা থাকে। আমার দোকানে আরও দুজন সহযোগী আছেন। তাদেরও সংসার চলছে।
যে কারণে বেড়েছে রপ্তানি
গেল বছর রপ্তানি বাড়ার কারণ জানতে চাইলে কুমিল্লা রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর সহকারী পরিচালক এএইচএম এরশাদুর রহমান বলেন, করোনাকালীন অনেক অর্ডার বন্ধ হয়ে যায়। তখন কেউ কারও দিকে তাকায়নি। একটা খারাপ অবস্থা ছিল। অন্যদিকে যুদ্ধরত দেশ আমদানি-রপ্তানি ছেড়ে সামরিক দিকে নজর দেয়। ইউক্রেন-রাশিয়ার সঙ্গে অনেক দেশ ব্যবসায় যুক্ত। যে কারণে শুধু কুমিল্লা ইপিজেডে নয়, সব দেশকে বিপাকে পড়তে হয়। পরবর্তীতে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ায় পণ্য রপ্তানি বেড়ে যায়।
একই কথা বলেছেন ইপিজেডের নির্বাহী পরিচালক আবদুল্লাহ আল মাহবুব। তিনি বলেন, কুমিল্লা ইপিজেডে প্রতিনিয়ত কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানির বিষয় থাকে। এতে একজন রপ্তানিকারক ভাগ্য বদলে দিতে পারেন। আবার কোনও একটি ছোট দুর্ঘটনা যেকোনো পরিস্থিতিকে বদলে দিতে পারে। যেমন ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। যা এখনও চলছে। তবে কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ায় আমাদের রপ্তানি বেড়েছে। কিন্তু রপ্তানির খাত বাড়েনি। আগে যারা আমাদের পণ্য নিতেন এখনও তারাই নিচ্ছেন, তবে পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছেন।
কুমিল্লা ইপিজেডে যেসব পণ্য উৎপাদন হয় এবং যেসব দেশে যায়
ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো ও যুক্তরাষ্ট্রে ৯৫ শতাংশ পণ্য রপ্তানি হয়। এর মধ্যে আছে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, স্পেন, বেলজিয়াম, বুলগেরিয়া, সাইপ্রাস, ক্রোয়েশিয়া, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স, গ্রিস, আয়ারল্যান্ড, ইতালি, লুক্সেমবার্গ, নেদারল্যান্ডস, পোল্যান্ড, পর্তুগাল, রোমানিয়া, স্লোভাকিয়া, স্লোভেনিয়া, সুইডেন, হাঙ্গেরিসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ। তবে রপ্তানি বেশি হয় জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশে।
বিনিয়োগে শীর্ষে আছে অন্তত ১৫টি দেশ। বাংলাদেশ ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, তাইওয়ান, কানাডা, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, নেদারল্যান্ডস, আয়ারল্যান্ড, পাকিস্তান, সিঙ্গাপুর ও হংকংয়ের বিনিয়োগ আছে কুমিল্লা ইপিজেডে।
উৎপাদিত পণ্যের মধ্যে রয়েছে, গার্মেন্টস অ্যাকসেসরিজ, সোয়েটার, ফেব্রিক্স, টেক্সটাইল ডাইজ অ্যান্ড অক্সিলিয়ারিজ, ইলেকট্রনিকস পার্টস, এলিমেনেটিং ব্রাশ, ফুটওয়্যার ও ফুটওয়্যার অ্যাপারেলস, ক্যামেরা কেস, ব্যাগ, ইয়ার্ন, প্লাস্টিক পণ্য, হেয়ার ও ফ্যাশন অ্যাকসেসারিজ, মেডিসিন বাক্স, আই প্যাচ, কার্পেট, গ্লাভস, লাগেজ, মেডেল, পেপার প্রোডাক্টসহ বিভিন্ন পণ্য।
বিগত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এই ইপিজেড থেকে প্রায় ৯০২ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এখানে তৈরি পোশাকের পাশাপাশি বিশ্বের বিখ্যাত ব্র্যান্ডের বিভিন্ন বৈচিত্রময় পণ্য যেমন- হেয়ার এক্সসরিজ ও বিউটি গুডস, লেদার ফুটওয়্যার ও ফুটওয়্যার এক্সসরিজ, কিচেন প্রোডাক্টস, মেডেল ও ট্রফি, ইলেক্ট্রিক্যাল ও ইলেক্ট্রনিক্স পণ্য, কেমিক্যাল, টেন্টস এন্ড স্লিপিং প্রোডাক্টস ইত্যাদি উৎপাদন ও রপ্তানি করছে।
রপ্তানিতে এগিয়ে যেসব প্রতিষ্ঠান
কুমিল্লা ইপিজেডে তিন ক্যাটাগরির প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এ ক্যাটাগরিতে অর্থাৎ বিদেশি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ৩০টি, বি ক্যাটাগরির অর্থাৎ যৌথ মালিকানাধীন সাতটি প্রতিষ্ঠান। সি ক্যাটাগরির বা দেশি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ১১টি। এর মধ্যে রপ্তানির শীর্ষে রয়েছে পাঁচ প্রতিষ্ঠান। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সর্বোচ্চ রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান এ ক্যাটাগরির মেসার্স কাদেনা স্পোর্টসওয়্যার লিমিটেড। চীনা মালিকানাধীন এই প্রতিষ্ঠান ২০১০ সালে ব্যবসা শুরু করেছিল। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটি ৯১ দশমিক ৬২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সমমূল্যের পণ্য রপ্তানি করেছে। এ ছাড়া বেশি রপ্তানিকারক বাকি চার প্রতিষ্ঠান হলো- সুরতি টেক্সটাইল (বিডি) লিমিটেড, নাসা তেইপ ডেনিমস লিমিটেড, জিংস্যাং সুজ (বিডি) লিমিটেড ও ইস্টপোর্ট লিমিটেড।
বিনিয়োগকারী থাকলেও প্লট পাচ্ছেন না
অতিরিক্ত বিনিয়োগকারী থাকলেও কুমিল্লা ইপিজেডের সব প্লট ইতিমধ্যে বিনিয়োগকারীদের অনুকূলে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। যে কারণে বর্তমানে বিনিয়োগ উপযোগী কোনও প্লট খালি না থাকায় বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও প্লট বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ইপিজেড কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, অনেক বিদেশি বিনিয়োগকারী আসেন এবং অনুরোধ করেন প্লট বরাদ্দ দেওয়ার জন্য। কিন্তু পর্যাপ্ত প্লট না থাকায় বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব হয় না। যদি সরকার প্লট বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়, তাহলে সেটি সম্ভব।
আবদুল্লাহ আল মাহবুব বলেন, এই ইপিজেড আরও সমৃদ্ধির অপেক্ষায় আছে। এটি দেশের মাঝামাজি ও বন্দর নগরী থেকে নিকটে হওয়াতে এটির গুরুত্ব অন্যদের থেকে আলাদা। যেকারণে এখানে বিনিয়োগকারীদের নজর বেশি। কিন্তু প্লট খালি না থাকায় আমরা সুযোগ দিতে পারছি না।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি করে রেকর্ড গড়েছে কুমিল্লা ইপিজেড। গত ২৪-২৫ অর্থ বছরে দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার মাঝেও ৯০২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার রপ্তানি করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
কুমিল্লা ইপিজেড সূত্রে জানা গেছে, দক্ষিণ চর্থা এলাকায় ২০০০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় কুমিল্লা ইপিজেড। এখানে ৪৮টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। যেখানে কর্মরত আছেন ৫০ হাজারের বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারী। গত তিন অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি করেছে দুই হাজার ৯৩৩ দশমিক ৬৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। তবে ২০২১ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত রপ্তানি না বেড়ে কমে গিয়েছিল। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৮১৪ দশমিক ৮২ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৭৯০ দশমিক ৯৫ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৭১১ দশমিক ৩৭ মিলিয়ন ডলারের পণ্য যায়।
৫০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান
কুমিল্লা ইপিজেডের দেয়া তথ্য মতে, বর্তমানে কুমিল্লা ইপিজেডে ৪৬টি শিল্প প্রতিষ্ঠান উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনা করছে এবং ৬টি প্রতিষ্ঠান বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। কুমিল্লা ইপিজেডে বিনিয়োগকৃত শিল্প প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৩১টি সম্পূর্ণ বিদেশি, আট দেশি বিদেশি যৌথ-উদ্যোগ এবং ১৩টি সম্পূর্ণ বাংলাদেশি মালিকানাধীন শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কুমিল্লা ইপিজেডের শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহে এখন পর্যন্ত প্রায় ৬১৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে। যেখানে প্রতিদিন ৫০ হাজারেরও বেশী স্থানীয় জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান হয়েছে।
স্বাবলম্বী হচ্ছেন নারীরাও
কুমিল্লা ইপিজেডে কর্মরত শ্রমিক কর্মচারীদের মধ্যে ৬৬শতাংশই নারী, যা অত্র অঞ্চলের নারীর ক্ষমতায়নের পাশাপাশি গ্রামীণ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। অনেক স্বামী পরিত্যক্তা নারী এই ইপিজেডে কাজ করেই তাদের ভাগ্য বদলেছেন। যার একটি বড় অংশ পরিবারের একমাত্র উপার্যনক্ষম নারী।
তাদের একজন কুমিল্লার নাঙ্গলকোট উপজেলার মাহীনি এলাকার মনোয়ারা বেগম। দুই সন্তান রেখে স্বামীর চলে যাওয়ার পর তিনি হাল ধরেছেন। দুই সন্তান পড়ালেখা করেন। আর মনোয়ারা এখন ইপিজেডের একজন দক্ষকর্মী। তিনি শহরে থাকলেও সন্তানরা গ্রামে পড়াশোনা করেন।
মনোয়ারার বেগম বলেন, কীভাবে সংসার চালাবো তাই ভাবছিলাম। স্বামী ছেড়ে যাওয়ার পর পাশের এলাকার একজন নারী কর্মী আমাকে এখানে নিয়ে আসে। এখন ভালোই চলছে সব।
স্থানীয় অর্থনীতিতে যেভাবে ভূমিকা রাখছে
প্রতিমাসে শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাবদ প্রায় ২৫০ কোটি টাকা ব্যয় করে থাকে। এছাড়া কুমিল্লা ইপিজেডে কর্মরত প্রায় ২৭০ জন বিদেশি কর্মী কুমিল্লা শহরের বিভিন্ন এলাকায় বসবাস করে। যারা কুমিল্লা ইপিজেড সংলগ্ন এলাকায় থাকেন। এতে করে একেবারে বদলে গেছে এই এলাকার অর্থনীতি। গড়ে উঠেছে নতুন বাজার। তৈরি হয়েছে আরও কয়েক হাজার কর্মসংস্থান। বেড়েছে এই এলাকার বাসাবাড়ির ভাড়া। যেন এক নতুন অর্থনৈতিক নগরী।
জানা গেছে, ইপিজেডের কোন বিনিয়োগকারী তাদের মোট আয়ের প্রায় ৮০ শতাংশ শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, ভাড়া ও ইউটিলিটি চার্জ, প্রতিষ্ঠানের কর্মরত বিদেশি নাগরিকদের জীবন ব্যয় এবং অন্যান্য পরিচালনাগত ব্যয় বাবদ খরচ করে যা স্থানীয় অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার পাশাপাশি সার্কুলার অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। ইপিজেডকে কেন্দ্র করে আবাসন, পরিবহন, রেস্টুরেন্ট, নির্মাণ শিল্প ও প্রতিষ্ঠানসহ ইপিজেডে সরবরাহের লক্ষ্যে বেকওয়ার্ড লিংকেজ ইন্ডাস্ট্রি তৈরি হয়েছে যার মাধ্যমে অত্র অঞ্চলের মানুষের জীবিকার অন্যতম উপজীব্য এই ইপিজেডকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হচ্ছে এবং সামষ্টিক অর্থনীতির বিকাশের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভমিকা পালন করছে।
ইপিজেড এলাকার ইয়াছিন মাকের্টের স্ট্রিট ফুড বিক্রেতা জেলার সদর উপজেলার ইব্রাহীম খলিল বলেন, আগে প্রবাসে ছিলাম। কিছু করতে পারিনি। ঋণ নিয়ে বাড়ি চলে এসেছি। প্রতি সন্ধ্যা ও বিকেলে এই এলাকায় চাপ, মাসালা এগুলো বিক্রি করি। এখন আর চিন্তা নেই। মাসে ৪০-৪৫ হাজার টাকা থাকে। আমার দোকানে আরও দুজন সহযোগী আছেন। তাদেরও সংসার চলছে।
যে কারণে বেড়েছে রপ্তানি
গেল বছর রপ্তানি বাড়ার কারণ জানতে চাইলে কুমিল্লা রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর সহকারী পরিচালক এএইচএম এরশাদুর রহমান বলেন, করোনাকালীন অনেক অর্ডার বন্ধ হয়ে যায়। তখন কেউ কারও দিকে তাকায়নি। একটা খারাপ অবস্থা ছিল। অন্যদিকে যুদ্ধরত দেশ আমদানি-রপ্তানি ছেড়ে সামরিক দিকে নজর দেয়। ইউক্রেন-রাশিয়ার সঙ্গে অনেক দেশ ব্যবসায় যুক্ত। যে কারণে শুধু কুমিল্লা ইপিজেডে নয়, সব দেশকে বিপাকে পড়তে হয়। পরবর্তীতে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ায় পণ্য রপ্তানি বেড়ে যায়।
একই কথা বলেছেন ইপিজেডের নির্বাহী পরিচালক আবদুল্লাহ আল মাহবুব। তিনি বলেন, কুমিল্লা ইপিজেডে প্রতিনিয়ত কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানির বিষয় থাকে। এতে একজন রপ্তানিকারক ভাগ্য বদলে দিতে পারেন। আবার কোনও একটি ছোট দুর্ঘটনা যেকোনো পরিস্থিতিকে বদলে দিতে পারে। যেমন ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। যা এখনও চলছে। তবে কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ায় আমাদের রপ্তানি বেড়েছে। কিন্তু রপ্তানির খাত বাড়েনি। আগে যারা আমাদের পণ্য নিতেন এখনও তারাই নিচ্ছেন, তবে পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছেন।
কুমিল্লা ইপিজেডে যেসব পণ্য উৎপাদন হয় এবং যেসব দেশে যায়
ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো ও যুক্তরাষ্ট্রে ৯৫ শতাংশ পণ্য রপ্তানি হয়। এর মধ্যে আছে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, স্পেন, বেলজিয়াম, বুলগেরিয়া, সাইপ্রাস, ক্রোয়েশিয়া, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স, গ্রিস, আয়ারল্যান্ড, ইতালি, লুক্সেমবার্গ, নেদারল্যান্ডস, পোল্যান্ড, পর্তুগাল, রোমানিয়া, স্লোভাকিয়া, স্লোভেনিয়া, সুইডেন, হাঙ্গেরিসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ। তবে রপ্তানি বেশি হয় জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশে।
বিনিয়োগে শীর্ষে আছে অন্তত ১৫টি দেশ। বাংলাদেশ ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, তাইওয়ান, কানাডা, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, নেদারল্যান্ডস, আয়ারল্যান্ড, পাকিস্তান, সিঙ্গাপুর ও হংকংয়ের বিনিয়োগ আছে কুমিল্লা ইপিজেডে।
উৎপাদিত পণ্যের মধ্যে রয়েছে, গার্মেন্টস অ্যাকসেসরিজ, সোয়েটার, ফেব্রিক্স, টেক্সটাইল ডাইজ অ্যান্ড অক্সিলিয়ারিজ, ইলেকট্রনিকস পার্টস, এলিমেনেটিং ব্রাশ, ফুটওয়্যার ও ফুটওয়্যার অ্যাপারেলস, ক্যামেরা কেস, ব্যাগ, ইয়ার্ন, প্লাস্টিক পণ্য, হেয়ার ও ফ্যাশন অ্যাকসেসারিজ, মেডিসিন বাক্স, আই প্যাচ, কার্পেট, গ্লাভস, লাগেজ, মেডেল, পেপার প্রোডাক্টসহ বিভিন্ন পণ্য।
বিগত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এই ইপিজেড থেকে প্রায় ৯০২ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এখানে তৈরি পোশাকের পাশাপাশি বিশ্বের বিখ্যাত ব্র্যান্ডের বিভিন্ন বৈচিত্রময় পণ্য যেমন- হেয়ার এক্সসরিজ ও বিউটি গুডস, লেদার ফুটওয়্যার ও ফুটওয়্যার এক্সসরিজ, কিচেন প্রোডাক্টস, মেডেল ও ট্রফি, ইলেক্ট্রিক্যাল ও ইলেক্ট্রনিক্স পণ্য, কেমিক্যাল, টেন্টস এন্ড স্লিপিং প্রোডাক্টস ইত্যাদি উৎপাদন ও রপ্তানি করছে।
রপ্তানিতে এগিয়ে যেসব প্রতিষ্ঠান
কুমিল্লা ইপিজেডে তিন ক্যাটাগরির প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এ ক্যাটাগরিতে অর্থাৎ বিদেশি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ৩০টি, বি ক্যাটাগরির অর্থাৎ যৌথ মালিকানাধীন সাতটি প্রতিষ্ঠান। সি ক্যাটাগরির বা দেশি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ১১টি। এর মধ্যে রপ্তানির শীর্ষে রয়েছে পাঁচ প্রতিষ্ঠান। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সর্বোচ্চ রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান এ ক্যাটাগরির মেসার্স কাদেনা স্পোর্টসওয়্যার লিমিটেড। চীনা মালিকানাধীন এই প্রতিষ্ঠান ২০১০ সালে ব্যবসা শুরু করেছিল। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটি ৯১ দশমিক ৬২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সমমূল্যের পণ্য রপ্তানি করেছে। এ ছাড়া বেশি রপ্তানিকারক বাকি চার প্রতিষ্ঠান হলো- সুরতি টেক্সটাইল (বিডি) লিমিটেড, নাসা তেইপ ডেনিমস লিমিটেড, জিংস্যাং সুজ (বিডি) লিমিটেড ও ইস্টপোর্ট লিমিটেড।
বিনিয়োগকারী থাকলেও প্লট পাচ্ছেন না
অতিরিক্ত বিনিয়োগকারী থাকলেও কুমিল্লা ইপিজেডের সব প্লট ইতিমধ্যে বিনিয়োগকারীদের অনুকূলে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। যে কারণে বর্তমানে বিনিয়োগ উপযোগী কোনও প্লট খালি না থাকায় বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও প্লট বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ইপিজেড কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, অনেক বিদেশি বিনিয়োগকারী আসেন এবং অনুরোধ করেন প্লট বরাদ্দ দেওয়ার জন্য। কিন্তু পর্যাপ্ত প্লট না থাকায় বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব হয় না। যদি সরকার প্লট বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়, তাহলে সেটি সম্ভব।
আবদুল্লাহ আল মাহবুব বলেন, এই ইপিজেড আরও সমৃদ্ধির অপেক্ষায় আছে। এটি দেশের মাঝামাজি ও বন্দর নগরী থেকে নিকটে হওয়াতে এটির গুরুত্ব অন্যদের থেকে আলাদা। যেকারণে এখানে বিনিয়োগকারীদের নজর বেশি। কিন্তু প্লট খালি না থাকায় আমরা সুযোগ দিতে পারছি না।