২৫ বছর কাঁচি হাতে রাশেদা, বদলেছে ৩০০ নারীর জীবন

Thumbnail image

গলায় ফিতা। হাতে কাঁচি। ভাঙা চেহারার রাশেদা হাতে কাঁচি আর গলায় ফিতা নিয়ে কাটিয়েছেন ২৫ বছর। গত ছয় বছর তাকে প্রতিনিয়ত দেখা যায় কুমিল্লা বিসিক ফটকে। সেখানে পাঁচ থেকে ছয় হাত লম্বা ও তিন থেকে চার হাত প্রশস্তের দোকান তাঁর । ২৫ বছরের কর্মজীবনে ৩০০ নারীকে শিখিয়েছেন সেলাই কাজ। আর ধরেছেন সংসারের হাল। গতকাল শুক্রবার সকালে বিসিক ফটকে কথা হয় রাশেদার সঙ্গে।

রাশেদা আক্তার কুমিল্লা নগরের বিসিক সংলগ্ন নোনাবাদ পুকুর পাড়ের গোলাম মাহমুদের স্ত্রী।

রাশেদার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৯৭ সালে মামার বাড়ি বাঞ্চারামপুর এলাকায় সেলাই কাজ শেখেন তিনি। সেই বছর বিয়ে হয় রাশেদার। নিজের বাড়ি কুমিল্লা নগরের বিসিক সংলগ্ন নোনাবাদ পুকুর পাড়ে। স্বামীর বাড়িও একই জায়গায়। বিয়ের পর থেকে স্বামীর বাড়ির অভাব অনটন দেখেছেন। তখনই নিজের পূর্বে শেখা দর্জি কাজ শুরুর সিদ্ধান্ত নেন। শুরু হয় রাশেদার সংগ্রাম।

এসময় রাশেদা আপ্লুত হয়ে পড়েন। বলেন, তখন সাল আনুমানিক ১৯৯৮। বিয়েতে মায়ের দেয়া গলার স্বর্ণের লকেট বিক্রি করি। পায়ে চাপা একটা সেলাই মেশিন কিনে ঘরের লোকেদের কাজ করা শুরু করি। তখন মেশিনের শব্দে পাশের ঘরের লোকেরাও এগিয়ে আসেন। তখন স্বামী যেখানে যে কাজ পেতেন তাই করতেন। এভাবে সংসার চলছিল না। টুকটাক কাজ করতাম। বছর খানেকের মাঝে গ্রামের প্রায় মানুষের কাজের অর্ডার পেতাম। কাজও শুরু করি। কিন্তু এর মাঝে মা হই। বাচ্চা লালনপালন করতে গিয়ে কাজ বন্ধ করে দিতে হয়।

এদিকে স্বামী নতুন করে হোটেল ব্যবসা ধরেন। হোটেলের কারিগর অনেক সময় আসত না, সেটা দেখতে হতো। এরপর বাচ্চা। পরিবার সামলানো, সেই সাথে আছে দর্জি কাজ। মানুষের দেয়া কথাও রাখতে হতো। সারাদিন কাজ করে হাঁপিয়ে যেতাম। হাত পা ব্যথায় রাতে ঘুমাতে পারতাম না। আবার সকালে উঠে শুরু হতো কাজ। এভাবে বেশ কয়েক বছর যায়। একসময় হোটেল ব্যবসায় মন্দা দেখা দেয়। তখন নিজেই শিঙাড়া, সমুচা, পুরিসহ সব আইটেম তৈরি করতাম। বাচ্চা তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়তো। এর মাঝে স্বপ্ন ছিল ছেলেকে বড় করব। তাই তাকে প্রতিদিন নিয়ে যেতাম কোচিংয়ে। কোচিং থেকে প্রাইভেটে। সেখান থেকে বাসায় নিয়ে আসতাম। রান্নাবান্না, সেলাইকাজ, হোটেলের কাজ তাঁর পর পরিবারের যত্নআত্তিতো আছেই। একটা সময় ছেলেটা জিলা স্কুলে চান্স পায়। ২০১৭ সালের কথা। তখন খুশিতে আমি আমার সব কষ্ট ভুলে যাই। তাঁর পর ছেলের জন্য আবার শুরু হয় সংগ্রাম। কারণ একটি মাত্র সন্তান ছিল।

রাশেদা বলেন, আমার স্বামী কোন ব্যবসাতেই তেমন সফল হতে পারেনি। তবে সে চেষ্টা করেছে। আমি টাকা জমিয়ে দোকান নিয়ে দিতাম আর তিনি কাজ করতেন। অজানা কারণে আবার সেই ব্যবসা ছাড়তে হতো। কয়েকদিন আগেও তিনি নতুন করে চা দোকান নিয়েছেন।

এসময় উপস্থিত হন রাশেদার স্বামী। রাশেদার স্বামী বলেন, আমি কষ্ট করেছি। কিন্তু রাশেদা যা করেছে অন্য মহিলারা তা করে কি না জানি না। সে অনেক পরিশ্রম করতে পারে। আমি মাঝে বিদেশে গিয়েছিলাম। সেখানে সমস্যায় পড়ে আবার ফিরে আসি। এসময় সে আমার সব সাপোর্ট দেয়।

৩০০ নারীকে কাজ শিখিয়েছেন রাশেদা

রাশেদা বলেন, ৩০০ নারীকে ২৫ বছরে কাজ শিখিয়েছি। তাদের মধ্যে অনেকে এখন ব্যবসা বাণিজ্য করছেন। অনেকে দোকান দিয়ে কুমিল্লা শহরে জায়গা জমি কিনেছেন। এখনও দেখা হলে জড়িয়ে ধরেন। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। ভালোলাগে। আমাকেও তাঁরা টাকা দিত। প্রতিজনকে কাজ শেখালে তখনকার আমলে ২ থেকে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত দিত।

উদাহরণ দিয়ে বলেন, তাল পুকুর পাড়ে একজন হিন্দু বোন এখনও ব্যবসা করেন। আমি বৃষ্টির মা বলে ডাকতাম। তিনি যখন আমার কাছে এসেছিলেন তখন তাঁর নবজাতক বাচ্চা বৃষ্টি কোলে ছিল। আমার খাটের ওপর ওই বাচ্চাকে ঘুম পাড়িয়ে কাজ শেখাতাম। বাচ্চাটা এখন মনেহয় কলেজে পড়ে। এখন তিনি তালপুকুরপাড়ের পরিচিত ব্যবসায়ী। কাপড় সেলাই করে পরিবার চালান। দেখা হলেই জড়িয়ে ধরেন। এসময় তিনি স্থান ও দোকানের নাম বলে অনেকে প্রশিক্ষণার্থীর সফলতার গল্প বলেন।

নারী হিসেবে কখনও প্রতিবন্ধকতার শিকার হয়েছেন কি না এমন প্রশ্নে তিনি বরেন, আমি কোনসময়ই আসলে নিজেকে নারী হিসেবে না দেখে মানুষ হিসেবে দেখেছি। তাছাড়া আমার স্বামী সব সময় ছায়ার মতো পাশে ছিলেন বলেন কোন সমস্যা মনেই হয়নি। আমি সব সময় তাকে পাশে পেয়েছি। আমি তাকে টুকটাক হাতের কাজ শিখিয়ে দিয়েছি। এতে করে সে আমাকে প্রায়শই কাজে সহযোগিতা করে থাকে। আমি ঈদ ও বিভিন্ন অকেশনে কাজের চাপে মাঝে মাঝে সাহ্রির সময় বাসায় যেতে হয়। সে আমার সাথে থাকে। সুতারাং নারী হিসেবে আমার প্রতিবন্ধকতার কোন সুযোগ ছিল না।

নারীদের কাজে আগ্রহী করা উচিত কি না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমি ৩০০ এর অধিক নারীকে কাজ শিখিয়েছি। তাঁরা কাজ করে এখন স্বাবলম্বী। কেউ আমাকে এসে বলেনি কাজ শিখে সমস্যায় পড়েছে। উল্টো আমাকে এসে বলেছে কাজ শিখে তাঁরা এখন ভালো আছে। নারীরা কাজ শিখে রাখা ভালো। এতে করে তাঁদের কারো দিকে চেয়ে থাকতে হয় না। অবহেলিত হতে হয় না।

বিষয়:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

সম্পর্কিত