নীড়ে ফিরেছেন হরিশ্চরিয়ানরা

জহিরুল ইসলাম
Thumbnail image

তিষট্টি বছর আগে মাধ্যমিকের গণ্ডি শেষ করেছেন। তের বছর আগে ছেড়েছেন শিক্ষকতা। বয়সের ভারে ন্যুয়ে পড়েছে শরীর। দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন কয়েকবছর আগে। তারপরও সহপাঠী ও সহকর্মীদের সাথে মিলিত হতে ছেলেদের কাঁধে ভর দিয়ে পুনর্মিলনীতে অংশ নিতে নীড়ে ফিরেছেন কুমিল্লার লালমাই উপজেলার শীর্ষ বিদ্যাপীঠ হরিশ্চর ইউনিয়ন হাই স্কুল এন্ড কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থী, প্রাক্তন শিক্ষক আবুল কালাম আজাদ (৭৮)।

একশ নয় বছর বয়সী বিদ্যালয়টির পুনর্মিলনীতে আসা সকলের নজর কেড়েছে আবুল কালাম আজাদের প্রিয় প্রাঙ্গনে ফেরার দৃশ্যটি।

ডাকাতিয়া নদীর পাড়ে ১৯১৬ সালে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়টি থেকে গত ৭৫ বছরে (১৯৫২-২০২৪) ৬ হাজার ৮৬ জন শিক্ষার্থী এসএসসি পাস করলেও চতুর্থ পুনর্মিলনীতে প্রায় ৩ হাজার প্রাক্তন শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করেছেন।

'নীড়ে ফেরা স্মৃতির টানে, মিলি প্রীতির বন্ধনে’ এই স্লোগানে বুধবার (২ এপ্রিল) সকালে বেলুন উড়িয়ে পুনর্মিলনী উদ্বোধন শেষে প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা একটি র‌্যালী বের করেন।

পবিত্র কোরআন তেলোয়াত ও অন্যান্য ধর্মীয় গ্রন্থ থেকে পাঠ এবং প্রকাশনার মোড়ক উন্মোচন শেষে পুনর্মিলনী উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক এবং বিদ্যালয়টির বর্তমান অধ্যক্ষ ইলিয়াছ কাঞ্চনের স্বাগত বক্তব্যের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের প্রথম পর্ব শুরু হয়।

এরপর বিদ্যালয়টির প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও ডিবিসি টিভির সিনিয়র সাংবাদিক মজুমদার জুয়েলের সাবলীল উপস্থাপনায় প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে একে একে স্মৃতি রোমন্থন করেন উদযাপন কমিটির প্রধান সমন্বয়ক প্রকৌশলী আবদুল বারী,

সভাপতি মনিরুল ইসলাম, সমন্বয়ক ডা: সালে আহমদ, শিল্পপতি হাজী শাহজাহান, বাংলাদেশ বেতারের প্রধান প্রকৌশলী মুনীর আহমেদ, সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আমান উল্যাহ আমান,

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোশারফ হোসেন, এনাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর ডা: মোতাহের হোসেন জুয়েল ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মো: আখতার হোসেন মজুমদার।

প্রাক্তন শিক্ষার্থী ডা. আশিকুর রহমান, ডা: শামীম ইকবাল মজুমদার ও মুহাম্মদ নজরুল ইসলামের যৌথ সঞ্চালনায় পুনর্মিলনীতে আরো বক্তব্য রাখেন শিল্পপতি কোরবান আলী, লালমাই প্রেসক্লাবের সভাপতি ড. শাহজাহান মজুমদার, সুপ্রিমকোর্টের এডভোকেট কামরুন নাহার কোহিনুর, কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা যুবদলের যুগ্ম আহবায়ক শাহ আলম, কিডনিরোগ বিশেষজ্ঞ ডা: শরীফ মজুমদার, মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা: আহসান উল্যাহ, হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা: হাসান ইকবাল মজুমদার, গাইনি বিশেষজ্ঞ ডা: মারজান সুলতানা নিজুম ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারি অধ্যাপক কামরুন নাহার পলি।

অতিথি হিসেবে পুনর্মিলনীতে বক্তব্য রাখেন সাবেক এমপি, বীরমুক্তিযোদ্ধা মনিরুল হক চৌধুরী, লালমাই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো: শাহ আলম ও লালমাই উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মোহাদুল্লাহ। আলোকিত এই বিদ্যালয়টি সরকারি করার দাবী জানিয়ে মনিরুল হক চৌধুরী বলেন, দেশের প্রতিটি জেলা-উপজেলায় একটি করে হরিশ্চর স্কুলের মডেলে প্রতিষ্ঠান গড়তে পারলে শিক্ষা ব্যবস্থা অনেক দূর এগিয়ে যাবে।

প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের মধ্যে পুনর্মিলনীতে অংশগ্রহণ করেন সরকারের সাবেক অতিরিক্ত সচিব জাফর ইকবাল, সাবেক যুগ্মসচিব মোহাম্মদ আবু ইউসুফ, হারাধন দে, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান, প্রফেসর আবুল খায়ের, মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রন অধিদপ্তরের চট্টগ্রামের পরিচালক খন্দকার হুমায়ুন কবির, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারি অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বিন আবদুল আজিজ, বাংলাদেশ ব্যাংকের যুগ্ম পরিচালক ফয়সাল ইবনে আবদুল হাই, বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের সহকারি পরিচালক আবু সাঈদ সিদ্দিকী শাওন, উদযাপন কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক রাশেদুজ্জামান শাহীন, সরকারের বিসিএস চিকিৎসা ক্যাডারের কর্মকর্তা ডা: নুর মোহাম্মদ শাহীন, ডা: পলাশ চন্দ্র দাশ, বিসিএস কর ক্যাডারের কর্মকর্তা জোনায়েদ হোসেন, এনআর ট্রাভেলস এজেন্সির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইমরান মজুমদার, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ইউএনও আমজাদ হোসেন অর্নব, মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট দিলরুবা আফরোজ তিথিসহ শিক্ষক, চিকিৎসক, সাংবাদিক, প্রকৌশলী, রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা।

অনুষ্ঠানে ৫২'র ভাষা আন্দোলন, ৭১'র মুক্তিযুদ্ধ ও ২৪'র ছাত্র আন্দোলনে শহিদদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে দোয়া মোনাজাত করা হয়।

সন্ধ্যায় র‍্যাফেল ড্র ও রাতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পুনর্মিলনীতে আসা প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের মধ্যে পুরো মাত্রায় আনন্দ ছড়িয়ে দেয়।

মূল আয়োজনের বাহিরে সহপাঠী ও শিক্ষকদের সাথে একত্রে মিলত হয়ে গ্রুপ ছবি তুলতে মাঠে ছিল এক ডজন মিনি স্টেজ। উপহার ও চা কফির জন্য প্রস্তুত ছিল ১১ টি স্টল। স্কুল মাঠে প্রবেশ করতেই রং বেরংয়ের ছাতার রাজ্যে প্রবেশ করে প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা।

ছেলেতের কাঁধে ভর দিয়ে বিদ্যালয়ে আসা আবুল কালাম বলেন, দুচোখে অন্ধকার দেখি। নিচের শক্তিতে হাটতে পারিনা। তবুও সহপাঠী, শিক্ষার্থী ও সহকর্মীতের টানে ছেলেদের সহযোগিতায় পুনর্মিলনীতে এসেছি।

পুনর্মিলনী উদযাপন পরিষদের কোষাধ্যক্ষ ডা: শামীম ইকবাল মজুমদার বলেন, প্রবীণ-নবীনের সমন্বয়ে পুনর্মিলনীর পুরো আয়োজন সাজানো হয়েছিল। ঈদ আনন্দ ও পুনর্মিলনী একই সময়ে হওয়ায় আয়োজন নিয়ে প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি নিয়মিত শিক্ষার্থী ও স্থানীয়দের মধ্যে বেশ আগ্রহ ছিল। শান্তিপূর্ণভাবে আয়োজনটি শেষ করতে পারায় শিক্ষক, প্রাক্তন শিক্ষার্থী, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট, সাংবাদিক, সেনাবাহিনী, পুলিশ ও আনসারদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।

পুনর্মিলনী উপলক্ষে প্রকাশিত নীড়ে ফেরা ম্যাগাজিনের কলাম 'এক নজরে হরিশ্চর' থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী উপজেলার খলিলপুর গ্রামের বাবু ভগবান চন্দ্র সাহা ও বাবু ঈশ্বর চন্দ্র সাহা ৩০ শতাংশ জমি দান করায় এই জমির উপর ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে একটি মাইনর স্কুল স্থাপিত হয় এবং নামকরণ করা হয় হরিশ্চর মধ্য ইংরেজি স্কুল। অতঃপর ১৯৪৯ সালের জানুয়ারি মাসে এটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে উন্নীত হয়।

১৯৬৬ সালে কুমিল্লা বোর্ডে বাণিজ্য বিভাগে মেধা তালিকায় প্রথম ও দ্বিতীয় স্থান দখল করার পর থেকে এ বিদ্যালয়ের সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। হরিশ্চর ইউনিয়ন হাইস্কুলের প্রথম প্রধান শিক্ষক ছিলেন স্বর্গীয় বাবু মহিম চন্দ্র সাহা। পরবর্তীতে মকবুল আহমেদ বিএসসি, বিটি ১৯৫০ সালে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করার জন্য হরিশ্চর ইউনিয়ন হাই স্কুলে যে মশাল প্রজ্বলিত করেছেন তা আজও স্ব-মহিমায় দীপ্তিমান।

বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির ভূমির পরিমাণ ৩.৫১ একর। হরিশ্চর নামটি প্রসিদ্ধ হওয়ার একমাত্র কারণ হরিশ্চর ইউনিয়ন হাই স্কুল। যুগ যুগ ধরে সাফল্যের দ্যুতি ছড়িয়েছে সুদূর মার্কিন মুল্লুকের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (নাসা) ও হালের ইনটেল কর্পোরেশন পর্যন্ত।

বিষয়:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

সম্পর্কিত