অধ্যাপক ডাঃ মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ
গেল কয়েক বছরে দেশে বজ্রাঘাতে প্রাণহানি সংখ্যা বেড়েছে বিশেষ করে শুরুতে এবারও বজ্রাঘাতে মৃত্যুর খবর আসেছে। সেই সঙ্গে ঘটছে নানাহ ক্ষয়ক্ষতি। গত সোমবার কুমিল্লার বরুড়ায় মাঠে ঘুড়ি উড়াচ্ছিল ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র ফাহাদ ও জিহাদ। এই সময় শুরু হয় বৃষ্টি ও বজ্রপাত। ঘরে ফেরার আগেই বজ্রপাতে মারা যায় তারা। এই দুই ভাই শিশুসহ গত সোমবার (২৮/৪/২০২৫) দেশের ৯ জেলায় ১৫ জন মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। দেশে প্রতিবছর বজ্রপাতে অনেক মানুষ মারা যাচ্ছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০১১ থেকে চলতি বছর ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত ১৫ বছরের বজ্রপাতে ৩৮৬৭ জনের মৃত্যুর ঘটেছে। বজ্রপাতে মৃত্যু রোধে এর আগে বেশ কিছু প্রকল্প নেওয়া হলেও আশানুরূপ ফল মেলেনি। এমন পরিস্থিতিতে বর্তমানে মৃত্যু কমাতে আগাম সতর্কতা বাড়ানোর পূর্বাভাস দেয়ার ও সচেতনতা বাড়ানোর উপর জোর দিচ্ছে সবাই।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দক্ষিণ এশিয়ার যে দেশগুলোতে বজ্রপাতের প্রবণতা বেশি তার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশও। বাংলাদেশের বজ্রপাত নিয়ে গবেষণা করেছেন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এম এ ফারুখ। তাঁর মতে, “বাংলাদেশের বজ্রপাতের মূল কারণ দেশটির ভৌগলিক অবস্থান। বাংলাদেশের একদিকে বঙ্গোপসাগর অপরদিকে ভারত মহাসাগর। সেখান থেকে গরম আর আর্দ্র বাতাস আসছে। আবার উত্তরে রয়েছে পাহাড়ি এলাকা, কিছু দূরে হিমালয় রয়েছে। সেখানে থেকে ঠান্ডা বাতাস ঢুকছে। এই দুটির বাতাসের সংমিশ্রণ বজ্রপাতের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করছে। তিনি বলেন, “দক্ষিণের গরম আর উত্তরে ঠান্ডা বাতাসে অস্থিতিশীল বাতাস তৈরি হয় আর এর থেকে তৈরি হয় বজ্রমেঘ। এরকম একটি মেঘের সঙ্গে আরেকটি মেঘের ঘর্ষণে বজ্র তৈরি হয়। এরকম উচ্চ ভোল্টেজ বৈদ্যুতিক তরঙ্গ যখন মাটিতে নেমে আসে, তখন সবচেয়ে কাছে যা পায়, তাতেই আঘাত করে।” বাংলাদেশের জাতীয় দূর্যোগের তালিকা ২০১৬ সালের ১৭ই মে বজ্রপাত অন্তর্ভূক্ত হয়।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলংকা, ভারতের কিছু অংশ, নেপালেও বজ্রপাত হয়। তবে এইসব দেশের তুলনায় বাংলাদেশের বজ্রপাতের প্রবণতা অনেক বেশি। দেশের আয়তনের তুলনায় হতাহতের সংখ্যা অনেক বেশি। এর কারণ হিসেবে সচেতনতার অভাবকেই দায়ী করা হয়। ভারত, মায়ানমার, শ্রীলঙ্কা বা নেপালে বজ্রপাত হলেও সেখানে মৃত্যুর হার এত বেশি নয়।
আবহাওয়াবিদদের পর্যবেক্ষণে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল বজ্রপাত প্রবন এলাকাগুলোর অন্যতম। গ্রীষ্মে এই অঞ্চলে তাপমাত্রা বেশি থাকায় এই পরিস্থিতি তৈরি হয় বলে তারা বলেছেন। কিছু গবেষক বলেছেন তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি বাড়লে বজ্রপাতের সম্ভাবনা ১০ শতাংশ বেড়ে যায়।যেসব এলাকায় মেঘের সৃষ্টি হয়, সেখান থেকে বজ্রপাতের সম্ভাবনা থাকে। পৃথিবীর যে কয়েকটি অঞ্চল বজ্রপাতপ্রবণ, তার মধ্যে দক্ষিণ এশিয়া অন্যতম। উন্নত দেশগুলোতে বজ্রাঘাতে মানুষের মৃত্যু কমলেও বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এই সংখ্যা বাড়ছে। বন্যা ও জ্বলোচ্ছাসের মতো দুর্যোগের ক্ষেত্রে কিছু প্রস্তুতি নেওয়ার সময় ও সুযোগ থাকলেও বজ্রপাতের বিষয়টি অনেকটা ভূমিকম্পের মতো আকস্মিক।
বিশ্বের সবচেযে বেশি বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে ভেনিজুয়েলা ও ব্রাজিলে। কিন্তু সেখানকার তুলনায় বাংলাদেশে মৃত্যুর ঘটনা অনেক বেশি। খোলা স্থানে মানুষের কাজ করা এবং বজ্রপাতের বিষয়ে তাদের অসচেতনতা এর কারণ হতে পারে বলে অভিজ্ঞ মহলের মত। এর বেশি শিকার হন খোলামাঠে কাজ করা কৃষক ও জেলেরা। বিশেষ করে হাওরাঞ্চলে খোলা জায়গায় কাজ করার কারণে সেখানে হতাহতের ঘটনা বেশি ঘটছে। গত কয়েক দশকে বড় বড় গাছ কেটে ফেলার কারণেও হতাহতের ঘটনা বেশি ঘটছে। আতঙ্কিত না হয়ে সতর্ক থাকলেই বজ্রপাতে মৃত্যু কমবে ঃ-
১। বজ্রপাতের সময় নৌকায় থাকলে নৌকার ছইয়ের নিচে অবস্থান নিতে হবে।
২। বজ্রপাতের সময় গাছের নিচে দাঁড়ানো নিরাপদ নয়।
৩। মাছধরা, ধান কাটা বন্ধ রাখতে হবে।
৪। নৌকায় ছই না থাকলে নিচু হয়ে নৌকার পাটাতনে যথাসাধ্য কম স্পর্শ করে অবস্থান নিতে হবে।
৫। জলাশয় থেকে দূরে থাকতে হবে।
৬। বাড়ি থেকে দূরে বাহিরে কোথাও থাকলে বজ্রপাতের সময় গাছের নিচে দাঁড়ানো নিরাপদ নয় এবং কোন উঁচু স্থানে অবস্থান নেয়া যাবে না।
৭। ছেড়া বিদ্যুতের তার থেকে দূরে থাকতে হবে।
৮। আকাশের কালো মেঘ দেখলে বা বজ্রপাতের শব্দ শোনা গেলে নিরাপদ স্থান যেমন ঘরের ভিতরে অবস্থান করতে হবে।
৯। বাইরে অবস্থান করলে কোন আশ্রয়ের জায়গা না পাওয়া গেলে যতটা সম্ভব নিচু হয়ে হাত-পা গুটিয়ে বসতে হবে। কোন অবস্থাতেই মাটিতে শুয়ে পড়া যাবে না।
১০। নিরাপদ নয় ুউন্মুক্ত স্থানে স্থাপিত তাবু, চারদিকে খোলা ছোট চালাযুক্ত স্থান, খোলা ও ধাতু নির্মিত যাত্রী ছাউনি, ছাতা ইত্যাদি
১১। বাড়ীর ভেতরের যেসব সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে ু দরজা, জানালা খোলা রাখা যাবে না। বৈদ্যুতিক লাইন ও বৈদ্যুতিক কোন যন্ত্রাংশ স্পর্শ করা যাবে না। বাথরুমের কল, সিঙ্ক, পাইপ, টিউবওয়েল স্পর্শ করা যাবে না। হাত ধোঁয়া, গোসল করা এবং থালা-বাসন ধোঁয়ার মত কাজ করা যাবে না। জানালার গ্রীল ধরে থাকা যাবে না।
ঝড়, বৃষ্টি ছাড়া পরিষ্কার ও নীল আকাশেও বজ্রপাত হতে পারে। বজ্রঝড়ের স্থান থেকে ১০ মাইল দূরেও বজ্রপাত আঘাত করতে পারে। বজ্রপাতের শব্দ শুনলেও বুঝতে হবে আপনি বজ্রপাতে আক্রান্ত হওয়ার সীমানার মধ্যে আছেন। তাই আকাশে মেঘ না থাকলেও বজ্রপাতের শব্দ শুনলেই ঘরে চলে যেতে হবে। মনে রাখতে হবে, বজ্রপাতের শব্দ শোনার পর কমপক্ষে ৩০ মিনিট নিরাপদ স্থানেই থাকতে হবে। কেউ বজ্রাহত হলে বজ্রাহত ব্যক্তিকে স্পর্শ করা সম্পূর্ণ নিরাপদ। বজ্রাহত ব্যক্তিকে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে, বজ্রাহত ব্যক্তি কোন সাড়া না দিলে প্রাথমিক চিকিৎসা হিসাবে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ব্যক্তি দ্বারা সিপিআর এর ব্যবস্থা করতে হবে। ২০১৬ সালে বজ্রপাতকে দুর্যোগ হিসাবে ঘোষণা করা হয় এবং এ দুর্যোগ থেকে দেশের মানুষকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য বেশকিছু পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছিল। বজ্রপাতে প্রাণহানি কমাতে লাখ লাখ তালগাছ লাগানোর প্রকল্প থেকে সুফল মিলেনি। তালগাছ লাগানো হয়েছে মূলত সড়কের পাশে। অথচ এক্ষেত্রে বেশির ভাগ মানুষ মারা যায় মাঠে। একটি তালগাছ বড় হওয়ার জন্য বহু বছর অপেক্ষা করতে হয়। এ দৃষ্টান্ত বিবেচনায় নিয়ে আগামী দিনে এ ধরনের প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে সতর্কতার পরিচয় দিতে হবে।
চলতি বছরের জানুয়ারী থেকে ২১ এপ্রিল পর্যন্ত মোট ৩৪ জন বজ্রপাতে মারা গেছেন। এর মধ্যে ফেব্রুয়ারীতে ৬, মার্চের দুই এবং এপ্রিলের প্রথম ২১ দিনে ২৬ জন মারা গেছেন। আহত হয়েছেন ১৬ জন। মৃত ব্যক্তিদের মধ্যে ১৭ জনই কৃষক। বজ্রপাতে ক্ষয়ক্ষতি ও বিপুল সংখ্যক প্রাণহানি বিবেচনা করে ২০১৬ সালে সরকার একে দূর্যোগ হিসাবে ঘোষণা করে। বজ্রপাত থেকে বাঁচাতে গত সরকারের সময় তালগাছ লাগানো, বজ্র নিরোধক ও লাইটনিং এরেষ্টার স্থাপনসহ কিছু প্রকল্প নেয়া হয়। এগুলো শেষ পর্যন্ত হতাহত কমাতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। আমরা এখন গুরুত্ব দিচ্ছি আলি ওয়ার্নিং (আগাম সতর্কভা)। এখন ১০ থেকে ১৫ মিনিটে আগে বজ্রপাতের পূর্বাভাস দেয়া সম্ভব। আর্লি ওয়ার্নিং যথাযথ সময়ে দিতে পারলে (এসএমএস ও ফোনকলের মাধ্যমে) জনগণকে সতর্ক করে দেয়া যাবে যাতে সবচেয়ে বেশি সবাই উপকৃত হবে।
অধ্যাপক ডাঃ মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ : সাবেক অধ্যক্ষ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ
গেল কয়েক বছরে দেশে বজ্রাঘাতে প্রাণহানি সংখ্যা বেড়েছে বিশেষ করে শুরুতে এবারও বজ্রাঘাতে মৃত্যুর খবর আসেছে। সেই সঙ্গে ঘটছে নানাহ ক্ষয়ক্ষতি। গত সোমবার কুমিল্লার বরুড়ায় মাঠে ঘুড়ি উড়াচ্ছিল ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র ফাহাদ ও জিহাদ। এই সময় শুরু হয় বৃষ্টি ও বজ্রপাত। ঘরে ফেরার আগেই বজ্রপাতে মারা যায় তারা। এই দুই ভাই শিশুসহ গত সোমবার (২৮/৪/২০২৫) দেশের ৯ জেলায় ১৫ জন মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। দেশে প্রতিবছর বজ্রপাতে অনেক মানুষ মারা যাচ্ছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০১১ থেকে চলতি বছর ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত ১৫ বছরের বজ্রপাতে ৩৮৬৭ জনের মৃত্যুর ঘটেছে। বজ্রপাতে মৃত্যু রোধে এর আগে বেশ কিছু প্রকল্প নেওয়া হলেও আশানুরূপ ফল মেলেনি। এমন পরিস্থিতিতে বর্তমানে মৃত্যু কমাতে আগাম সতর্কতা বাড়ানোর পূর্বাভাস দেয়ার ও সচেতনতা বাড়ানোর উপর জোর দিচ্ছে সবাই।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দক্ষিণ এশিয়ার যে দেশগুলোতে বজ্রপাতের প্রবণতা বেশি তার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশও। বাংলাদেশের বজ্রপাত নিয়ে গবেষণা করেছেন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এম এ ফারুখ। তাঁর মতে, “বাংলাদেশের বজ্রপাতের মূল কারণ দেশটির ভৌগলিক অবস্থান। বাংলাদেশের একদিকে বঙ্গোপসাগর অপরদিকে ভারত মহাসাগর। সেখান থেকে গরম আর আর্দ্র বাতাস আসছে। আবার উত্তরে রয়েছে পাহাড়ি এলাকা, কিছু দূরে হিমালয় রয়েছে। সেখানে থেকে ঠান্ডা বাতাস ঢুকছে। এই দুটির বাতাসের সংমিশ্রণ বজ্রপাতের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করছে। তিনি বলেন, “দক্ষিণের গরম আর উত্তরে ঠান্ডা বাতাসে অস্থিতিশীল বাতাস তৈরি হয় আর এর থেকে তৈরি হয় বজ্রমেঘ। এরকম একটি মেঘের সঙ্গে আরেকটি মেঘের ঘর্ষণে বজ্র তৈরি হয়। এরকম উচ্চ ভোল্টেজ বৈদ্যুতিক তরঙ্গ যখন মাটিতে নেমে আসে, তখন সবচেয়ে কাছে যা পায়, তাতেই আঘাত করে।” বাংলাদেশের জাতীয় দূর্যোগের তালিকা ২০১৬ সালের ১৭ই মে বজ্রপাত অন্তর্ভূক্ত হয়।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলংকা, ভারতের কিছু অংশ, নেপালেও বজ্রপাত হয়। তবে এইসব দেশের তুলনায় বাংলাদেশের বজ্রপাতের প্রবণতা অনেক বেশি। দেশের আয়তনের তুলনায় হতাহতের সংখ্যা অনেক বেশি। এর কারণ হিসেবে সচেতনতার অভাবকেই দায়ী করা হয়। ভারত, মায়ানমার, শ্রীলঙ্কা বা নেপালে বজ্রপাত হলেও সেখানে মৃত্যুর হার এত বেশি নয়।
আবহাওয়াবিদদের পর্যবেক্ষণে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল বজ্রপাত প্রবন এলাকাগুলোর অন্যতম। গ্রীষ্মে এই অঞ্চলে তাপমাত্রা বেশি থাকায় এই পরিস্থিতি তৈরি হয় বলে তারা বলেছেন। কিছু গবেষক বলেছেন তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি বাড়লে বজ্রপাতের সম্ভাবনা ১০ শতাংশ বেড়ে যায়।যেসব এলাকায় মেঘের সৃষ্টি হয়, সেখান থেকে বজ্রপাতের সম্ভাবনা থাকে। পৃথিবীর যে কয়েকটি অঞ্চল বজ্রপাতপ্রবণ, তার মধ্যে দক্ষিণ এশিয়া অন্যতম। উন্নত দেশগুলোতে বজ্রাঘাতে মানুষের মৃত্যু কমলেও বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এই সংখ্যা বাড়ছে। বন্যা ও জ্বলোচ্ছাসের মতো দুর্যোগের ক্ষেত্রে কিছু প্রস্তুতি নেওয়ার সময় ও সুযোগ থাকলেও বজ্রপাতের বিষয়টি অনেকটা ভূমিকম্পের মতো আকস্মিক।
বিশ্বের সবচেযে বেশি বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে ভেনিজুয়েলা ও ব্রাজিলে। কিন্তু সেখানকার তুলনায় বাংলাদেশে মৃত্যুর ঘটনা অনেক বেশি। খোলা স্থানে মানুষের কাজ করা এবং বজ্রপাতের বিষয়ে তাদের অসচেতনতা এর কারণ হতে পারে বলে অভিজ্ঞ মহলের মত। এর বেশি শিকার হন খোলামাঠে কাজ করা কৃষক ও জেলেরা। বিশেষ করে হাওরাঞ্চলে খোলা জায়গায় কাজ করার কারণে সেখানে হতাহতের ঘটনা বেশি ঘটছে। গত কয়েক দশকে বড় বড় গাছ কেটে ফেলার কারণেও হতাহতের ঘটনা বেশি ঘটছে। আতঙ্কিত না হয়ে সতর্ক থাকলেই বজ্রপাতে মৃত্যু কমবে ঃ-
১। বজ্রপাতের সময় নৌকায় থাকলে নৌকার ছইয়ের নিচে অবস্থান নিতে হবে।
২। বজ্রপাতের সময় গাছের নিচে দাঁড়ানো নিরাপদ নয়।
৩। মাছধরা, ধান কাটা বন্ধ রাখতে হবে।
৪। নৌকায় ছই না থাকলে নিচু হয়ে নৌকার পাটাতনে যথাসাধ্য কম স্পর্শ করে অবস্থান নিতে হবে।
৫। জলাশয় থেকে দূরে থাকতে হবে।
৬। বাড়ি থেকে দূরে বাহিরে কোথাও থাকলে বজ্রপাতের সময় গাছের নিচে দাঁড়ানো নিরাপদ নয় এবং কোন উঁচু স্থানে অবস্থান নেয়া যাবে না।
৭। ছেড়া বিদ্যুতের তার থেকে দূরে থাকতে হবে।
৮। আকাশের কালো মেঘ দেখলে বা বজ্রপাতের শব্দ শোনা গেলে নিরাপদ স্থান যেমন ঘরের ভিতরে অবস্থান করতে হবে।
৯। বাইরে অবস্থান করলে কোন আশ্রয়ের জায়গা না পাওয়া গেলে যতটা সম্ভব নিচু হয়ে হাত-পা গুটিয়ে বসতে হবে। কোন অবস্থাতেই মাটিতে শুয়ে পড়া যাবে না।
১০। নিরাপদ নয় ুউন্মুক্ত স্থানে স্থাপিত তাবু, চারদিকে খোলা ছোট চালাযুক্ত স্থান, খোলা ও ধাতু নির্মিত যাত্রী ছাউনি, ছাতা ইত্যাদি
১১। বাড়ীর ভেতরের যেসব সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে ু দরজা, জানালা খোলা রাখা যাবে না। বৈদ্যুতিক লাইন ও বৈদ্যুতিক কোন যন্ত্রাংশ স্পর্শ করা যাবে না। বাথরুমের কল, সিঙ্ক, পাইপ, টিউবওয়েল স্পর্শ করা যাবে না। হাত ধোঁয়া, গোসল করা এবং থালা-বাসন ধোঁয়ার মত কাজ করা যাবে না। জানালার গ্রীল ধরে থাকা যাবে না।
ঝড়, বৃষ্টি ছাড়া পরিষ্কার ও নীল আকাশেও বজ্রপাত হতে পারে। বজ্রঝড়ের স্থান থেকে ১০ মাইল দূরেও বজ্রপাত আঘাত করতে পারে। বজ্রপাতের শব্দ শুনলেও বুঝতে হবে আপনি বজ্রপাতে আক্রান্ত হওয়ার সীমানার মধ্যে আছেন। তাই আকাশে মেঘ না থাকলেও বজ্রপাতের শব্দ শুনলেই ঘরে চলে যেতে হবে। মনে রাখতে হবে, বজ্রপাতের শব্দ শোনার পর কমপক্ষে ৩০ মিনিট নিরাপদ স্থানেই থাকতে হবে। কেউ বজ্রাহত হলে বজ্রাহত ব্যক্তিকে স্পর্শ করা সম্পূর্ণ নিরাপদ। বজ্রাহত ব্যক্তিকে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে, বজ্রাহত ব্যক্তি কোন সাড়া না দিলে প্রাথমিক চিকিৎসা হিসাবে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ব্যক্তি দ্বারা সিপিআর এর ব্যবস্থা করতে হবে। ২০১৬ সালে বজ্রপাতকে দুর্যোগ হিসাবে ঘোষণা করা হয় এবং এ দুর্যোগ থেকে দেশের মানুষকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য বেশকিছু পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছিল। বজ্রপাতে প্রাণহানি কমাতে লাখ লাখ তালগাছ লাগানোর প্রকল্প থেকে সুফল মিলেনি। তালগাছ লাগানো হয়েছে মূলত সড়কের পাশে। অথচ এক্ষেত্রে বেশির ভাগ মানুষ মারা যায় মাঠে। একটি তালগাছ বড় হওয়ার জন্য বহু বছর অপেক্ষা করতে হয়। এ দৃষ্টান্ত বিবেচনায় নিয়ে আগামী দিনে এ ধরনের প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে সতর্কতার পরিচয় দিতে হবে।
চলতি বছরের জানুয়ারী থেকে ২১ এপ্রিল পর্যন্ত মোট ৩৪ জন বজ্রপাতে মারা গেছেন। এর মধ্যে ফেব্রুয়ারীতে ৬, মার্চের দুই এবং এপ্রিলের প্রথম ২১ দিনে ২৬ জন মারা গেছেন। আহত হয়েছেন ১৬ জন। মৃত ব্যক্তিদের মধ্যে ১৭ জনই কৃষক। বজ্রপাতে ক্ষয়ক্ষতি ও বিপুল সংখ্যক প্রাণহানি বিবেচনা করে ২০১৬ সালে সরকার একে দূর্যোগ হিসাবে ঘোষণা করে। বজ্রপাত থেকে বাঁচাতে গত সরকারের সময় তালগাছ লাগানো, বজ্র নিরোধক ও লাইটনিং এরেষ্টার স্থাপনসহ কিছু প্রকল্প নেয়া হয়। এগুলো শেষ পর্যন্ত হতাহত কমাতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। আমরা এখন গুরুত্ব দিচ্ছি আলি ওয়ার্নিং (আগাম সতর্কভা)। এখন ১০ থেকে ১৫ মিনিটে আগে বজ্রপাতের পূর্বাভাস দেয়া সম্ভব। আর্লি ওয়ার্নিং যথাযথ সময়ে দিতে পারলে (এসএমএস ও ফোনকলের মাধ্যমে) জনগণকে সতর্ক করে দেয়া যাবে যাতে সবচেয়ে বেশি সবাই উপকৃত হবে।
অধ্যাপক ডাঃ মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ : সাবেক অধ্যক্ষ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ