গাজীউল হক সোহাগ
সেদিন ছিল ২৫ এপ্রিল। ঘড়ির কাঁটায় তখন বিকেল চারটা পেরিয়ে গেছে। কুমিল্লা নগরের কান্দিরপাড় ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের পাশের সড়কে শত শত কিশোরের হাতে প্রকাশ্যে চাপাতি, চাকু, ছুরি। হুড়োহুড়ি, দৌড়াদৌড়ি, শোডাউন। তখন রানীরদিঘির পাড়ের কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের উচ্চমাধ্যমিক শাখায় কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথমবর্ষের ভর্তি পরীক্ষা চলছিল। কলেজের ১০ তলা একাডেমিক ভবনে কর্তব্যরত বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নারী শিক্ষক মুঠোফোনে জানালেন-কি হয়েছে সড়কে? এতো কিশোর কোথায় যাচ্ছে? কিশোরের দল কলেজ মসজিদ পার হয়ে রানীরদিঘির উত্তরপাড় হয়ে পূর্বপাড়ের সড়ক দিয়ে যাচ্ছে। মোটর সাইকেলের অসহনীয় আওয়াজ। আতঙ্কে কুঁকড়ে গেল ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের অভিভাবকেরা। সন্ধ্যার সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে চাপাতি হাতে কিশোরদের মহড়ার দৃশ্য। যেন এক সিনেমার দৃশ্য। এর আগে কখনো এতো ব্যাপকভাবে সংঘবদ্ধ হয়ে শোডাউন করতে দেখা যায়নি কিশোর গ্যাংকে।
সেইদিনের ঘটনার পর পুরো নগরজুড়ে আবারও আলোচনায় আসে কিশোর গ্যাং। এর আগে কিশোর গ্যাংয়ের আধিপত্য বিস্তার, সিনিয়র জুনিয়র দ্বন্দ্ব, মেয়ে পছন্দ নিয়ে একপক্ষ আরেক পক্ষের ওপর ছুরিকাঘাতে ও তুচ্ছ কারণে কুমিল্লা নগরে খুনোখুনির ঘটনা ঘটেছে। অতীতের সবগুলো ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে , রাজনৈতিক দলের নেতা ও তাঁদের স্বজনেরা কিশোর গ্যাংকে প্রশ্রয় দিয়েছেন।
মনে পড়ে, ২০২২ সালের ২৬ মার্চ । ভরদুপুর পেরিয়ে বিকেলের শুরু। কুমিল্লা নগরের তালপুকুরপাড়ের পশ্চিম, দক্ষিণ ও পূর্বপাড়ে সহস্রাধিক কিশোর বাঁশের কঞ্চি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। বাঁশের কঞ্চির ডগায় জাতীয় পতাকা। বিকেলে এই কিশোরদের নিয়ে কুমিল্লা নগরে শোডাউন করেন দোর্দণ্ড প্রভাবশালী এক নেতার স্বজন। কিশোরদের ওই শোডাউন পুলিশ বাদুরতলা এলাকার স্বপ্নের সামনে আটকে দেয়। আরও মনে পড়ে, মোগলটুলি এলাকায় এক দোকানের সামনে ঈগল গ্রুপ ও রতন গ্রুপের দ্বন্দ্বে ঝাউতলা এলাকার এক কিশোর মারা যান। কোন এক রমজানে মদিনা মসজিদ এলাকায় তারাবির নামাজের সময় কুমিল্লা মডার্ন হাইস্কুলের এক ছাত্র সিনিয়র- জুনিয়র দ্বন্দ্বে ছুরিকাঘাতে মারা যায়।
কিশোর গ্যাং একদিনে বিকশিত হয়নি। এটি বিকশিত হয়েছে অন্তত কুড়ি বছর আগে। তখন নগরের ভিক্টোরিয়া কলেজ , বাগিচাগাঁও ও ঠাকুরপাড়া এলাকায় মুঠোফোন ঠেক দিয়ে নেওয়া হতো। বড় দুইটি রাজনৈতিক দলের ছাত্রনেতারা এদের আশ্রয় দিতেন। পরবর্তীতে কিশোর গ্যাং কুমিল্লা নগরের ধর্মসাগরপাড়, ঈদগাহ এলাকায় ঘাঁটি করে। এখন কুমিল্লা জিলা স্কুল, কুমিল্লা হাইস্কুল ও মডার্ন স্কুল, অশোকতলা ও তালপুকুরপাড় এলাকায় মহড়া দেয়। কুমিল্লা জিলা স্কুল সড়ক ও রানীরকুঠিরের সামনের সড়কে কিশোর গ্যাংয়ের মোটরসাইকেল বিকট শব্দে সর্পিলাকারে চালিয়ে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়ায়। শুক্র ও শনিবার বিকেলে নগর উদ্যানের দক্ষিণ পাশে কিশোর গ্যাং প্রতিনিয়ত মহড়া দেয়। এতে বিকেলে হাঁটতে আসা নারী, পুরুষদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দেয়।
কুমিল্লায় গত ২৫ এপ্রিলের মহড়ায় যুবদলের এক নেতার ছেলেসহ অন্তত ৩০ জন আটক হয়েছেন। কুমিল্লার মানুষ ওইদিনের ঘটনায় স্তম্ভিত। বিস্ময়ে হতবাক! সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন পর্যায়ের উঠতি নেতাদের মিছিলে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের দেখা মেলে। কিশোর গ্যাংদের ব্যবহার করে মিছিল দীর্ঘ করা হয়। আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের এক সহপাঠী সেদিন জানালেন- অমুক নেতা তো কিশোর গ্যাং থেকেই তরতর করে উঠেছেন। সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণে মনে হল- কিশোর গ্যাংকে আশ্রয় প্রশ্রয় দিচ্ছেন রাজনৈতিক নেতারা। কিশোর গ্যাং সবসময়ই ক্ষমতাসীন বা ক্ষমতাবানদের কব্জায় থাকে। এর থেকে কুমিল্লা নগরবাসীকে পরিত্রাণ পেতে হলে পরিবার থেকে কিশোর গ্যাংকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। পরিবারের কর্তাদের নজরদারি বাড়াতে হবে। তাঁদের সন্তান কোথায় যাচ্ছে? কার সঙ্গে চলাফেরা করছে? মুঠোফোনের অপব্যবহার করছে কি না?
এটা নিশ্চিত করে বলতে চাই, কিশোর গ্যাং সব ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িত। পারিবারিক স্নেহ, ভালোবাসা, মায়ার বন্ধনে এদের আনতে হবে। তা না হলে সামাজিক অপরাধ ক্রমাগত বাড়তে থাকবে। শান্তির কুমিল্লায় অশান্তি দেখা দেবে। কুমিল্লার বদনাম হবে। ইতিহাস ঐতিহ্যের শহরের বদনাম আমরা চাই না।
আমরা সাধুবাদ জানাই ২৫ এপ্রিলের ঘটনার পর, কুমিল্লার প্রশাসন বিষয়টি কঠোরভাবে নিয়েছে। যৌথবাহিনীর অভিযানে একে একে ধরা পড়ছে কিশোর গ্যাং দলের সদস্যরা। এই অভিযান অব্যাহত রাখতে হবে। বিভিন্ন স্পটে সাদা পোশাকের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতি ও নজরদারি বাড়াতে হবে।
এই ধরনের অপরাধ কোনভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।
রাজনীতিবিদদের প্রতি অনুরোধ, চাপাতি নয়, কিশোরদের হাতে বইখাতা কলম তুলে দেন। কেননা -‘অসির চেয়ে মসি বড়’।
গাজীউল হক সোহাগ: সম্পাদক, আমার শহর
সেদিন ছিল ২৫ এপ্রিল। ঘড়ির কাঁটায় তখন বিকেল চারটা পেরিয়ে গেছে। কুমিল্লা নগরের কান্দিরপাড় ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের পাশের সড়কে শত শত কিশোরের হাতে প্রকাশ্যে চাপাতি, চাকু, ছুরি। হুড়োহুড়ি, দৌড়াদৌড়ি, শোডাউন। তখন রানীরদিঘির পাড়ের কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের উচ্চমাধ্যমিক শাখায় কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথমবর্ষের ভর্তি পরীক্ষা চলছিল। কলেজের ১০ তলা একাডেমিক ভবনে কর্তব্যরত বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নারী শিক্ষক মুঠোফোনে জানালেন-কি হয়েছে সড়কে? এতো কিশোর কোথায় যাচ্ছে? কিশোরের দল কলেজ মসজিদ পার হয়ে রানীরদিঘির উত্তরপাড় হয়ে পূর্বপাড়ের সড়ক দিয়ে যাচ্ছে। মোটর সাইকেলের অসহনীয় আওয়াজ। আতঙ্কে কুঁকড়ে গেল ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের অভিভাবকেরা। সন্ধ্যার সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে চাপাতি হাতে কিশোরদের মহড়ার দৃশ্য। যেন এক সিনেমার দৃশ্য। এর আগে কখনো এতো ব্যাপকভাবে সংঘবদ্ধ হয়ে শোডাউন করতে দেখা যায়নি কিশোর গ্যাংকে।
সেইদিনের ঘটনার পর পুরো নগরজুড়ে আবারও আলোচনায় আসে কিশোর গ্যাং। এর আগে কিশোর গ্যাংয়ের আধিপত্য বিস্তার, সিনিয়র জুনিয়র দ্বন্দ্ব, মেয়ে পছন্দ নিয়ে একপক্ষ আরেক পক্ষের ওপর ছুরিকাঘাতে ও তুচ্ছ কারণে কুমিল্লা নগরে খুনোখুনির ঘটনা ঘটেছে। অতীতের সবগুলো ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে , রাজনৈতিক দলের নেতা ও তাঁদের স্বজনেরা কিশোর গ্যাংকে প্রশ্রয় দিয়েছেন।
মনে পড়ে, ২০২২ সালের ২৬ মার্চ । ভরদুপুর পেরিয়ে বিকেলের শুরু। কুমিল্লা নগরের তালপুকুরপাড়ের পশ্চিম, দক্ষিণ ও পূর্বপাড়ে সহস্রাধিক কিশোর বাঁশের কঞ্চি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। বাঁশের কঞ্চির ডগায় জাতীয় পতাকা। বিকেলে এই কিশোরদের নিয়ে কুমিল্লা নগরে শোডাউন করেন দোর্দণ্ড প্রভাবশালী এক নেতার স্বজন। কিশোরদের ওই শোডাউন পুলিশ বাদুরতলা এলাকার স্বপ্নের সামনে আটকে দেয়। আরও মনে পড়ে, মোগলটুলি এলাকায় এক দোকানের সামনে ঈগল গ্রুপ ও রতন গ্রুপের দ্বন্দ্বে ঝাউতলা এলাকার এক কিশোর মারা যান। কোন এক রমজানে মদিনা মসজিদ এলাকায় তারাবির নামাজের সময় কুমিল্লা মডার্ন হাইস্কুলের এক ছাত্র সিনিয়র- জুনিয়র দ্বন্দ্বে ছুরিকাঘাতে মারা যায়।
কিশোর গ্যাং একদিনে বিকশিত হয়নি। এটি বিকশিত হয়েছে অন্তত কুড়ি বছর আগে। তখন নগরের ভিক্টোরিয়া কলেজ , বাগিচাগাঁও ও ঠাকুরপাড়া এলাকায় মুঠোফোন ঠেক দিয়ে নেওয়া হতো। বড় দুইটি রাজনৈতিক দলের ছাত্রনেতারা এদের আশ্রয় দিতেন। পরবর্তীতে কিশোর গ্যাং কুমিল্লা নগরের ধর্মসাগরপাড়, ঈদগাহ এলাকায় ঘাঁটি করে। এখন কুমিল্লা জিলা স্কুল, কুমিল্লা হাইস্কুল ও মডার্ন স্কুল, অশোকতলা ও তালপুকুরপাড় এলাকায় মহড়া দেয়। কুমিল্লা জিলা স্কুল সড়ক ও রানীরকুঠিরের সামনের সড়কে কিশোর গ্যাংয়ের মোটরসাইকেল বিকট শব্দে সর্পিলাকারে চালিয়ে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়ায়। শুক্র ও শনিবার বিকেলে নগর উদ্যানের দক্ষিণ পাশে কিশোর গ্যাং প্রতিনিয়ত মহড়া দেয়। এতে বিকেলে হাঁটতে আসা নারী, পুরুষদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দেয়।
কুমিল্লায় গত ২৫ এপ্রিলের মহড়ায় যুবদলের এক নেতার ছেলেসহ অন্তত ৩০ জন আটক হয়েছেন। কুমিল্লার মানুষ ওইদিনের ঘটনায় স্তম্ভিত। বিস্ময়ে হতবাক! সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন পর্যায়ের উঠতি নেতাদের মিছিলে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের দেখা মেলে। কিশোর গ্যাংদের ব্যবহার করে মিছিল দীর্ঘ করা হয়। আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের এক সহপাঠী সেদিন জানালেন- অমুক নেতা তো কিশোর গ্যাং থেকেই তরতর করে উঠেছেন। সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণে মনে হল- কিশোর গ্যাংকে আশ্রয় প্রশ্রয় দিচ্ছেন রাজনৈতিক নেতারা। কিশোর গ্যাং সবসময়ই ক্ষমতাসীন বা ক্ষমতাবানদের কব্জায় থাকে। এর থেকে কুমিল্লা নগরবাসীকে পরিত্রাণ পেতে হলে পরিবার থেকে কিশোর গ্যাংকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। পরিবারের কর্তাদের নজরদারি বাড়াতে হবে। তাঁদের সন্তান কোথায় যাচ্ছে? কার সঙ্গে চলাফেরা করছে? মুঠোফোনের অপব্যবহার করছে কি না?
এটা নিশ্চিত করে বলতে চাই, কিশোর গ্যাং সব ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িত। পারিবারিক স্নেহ, ভালোবাসা, মায়ার বন্ধনে এদের আনতে হবে। তা না হলে সামাজিক অপরাধ ক্রমাগত বাড়তে থাকবে। শান্তির কুমিল্লায় অশান্তি দেখা দেবে। কুমিল্লার বদনাম হবে। ইতিহাস ঐতিহ্যের শহরের বদনাম আমরা চাই না।
আমরা সাধুবাদ জানাই ২৫ এপ্রিলের ঘটনার পর, কুমিল্লার প্রশাসন বিষয়টি কঠোরভাবে নিয়েছে। যৌথবাহিনীর অভিযানে একে একে ধরা পড়ছে কিশোর গ্যাং দলের সদস্যরা। এই অভিযান অব্যাহত রাখতে হবে। বিভিন্ন স্পটে সাদা পোশাকের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতি ও নজরদারি বাড়াতে হবে।
এই ধরনের অপরাধ কোনভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।
রাজনীতিবিদদের প্রতি অনুরোধ, চাপাতি নয়, কিশোরদের হাতে বইখাতা কলম তুলে দেন। কেননা -‘অসির চেয়ে মসি বড়’।
গাজীউল হক সোহাগ: সম্পাদক, আমার শহর