বাবা দিবস
ইউ কে এম ফারহানা সুলতানা শায়লা
সেই অনেকদিন আগের কথা। আমরা তখন চার বোনই বাড়ির বাইরে পড়াশোনার উদ্দেশ্যে। সবাই হলে থাকি। একেকজন একেক জায়গায়। বাসায় শুধু আব্বু আম্মা আর ছোট্ট ভাইটা। একদিন আব্বু একটা বিশাল বড় মাছ নিয়ে আসলো, নদীর। তো সেই মাছ তো আর তাদের গলা দিয়ে নামছে না। মেয়েরা কেউই পাশে নেই। আর আমরা তখন কোন একটা ছুটির শেষে মাত্রই সবাই হলে ফিরেছি। সহসা আসা হবে না। তখন আম্মা মাছ রান্না করে বাটিতে করে করে দিলো আর আব্বু সেই বাটি নিয়ে কুমিল্লা থেকে ঢাকা, বগুড়া আর রাজশাহীতে মেয়েদের কাছে পৌঁছে দিলো। ব্যাপারটা অদ্ভূত।এই তুচ্ছ একটা ব্যাপারে এত কাহিনী করা! কিন্তু হয়তোবা বাবা মায়ের কাছে এগুলো অদ্ভূত না।
ছোটবেলার সবচেয়ে সুন্দর স্মৃতিগুলোর মধ্যে ছিলো আব্বুর হাত ধরে আমরা চার বোন যখন আশেপাশে বেড়াতে যেতাম। আগে বৃহস্পতিবার ছিলো হাফ অফিস আর শুক্রবার পুরো ছুটি। তখন থাকতাম ব্রাহ্মণ্ণপবাড়িয়ায়। বাসা থেকে কিছু দূরেই ছিলো একটা খাল। বৃহস্পতিবার দুপুরে খাওয়ার পরই আমরা আব্বুর সাথে চলে যেতাম সেই খালপাড়ে। আব্বু বসে থাকতো, কারোর সাথে গল্প করতো বা পেপার পড়তো আর আমরা এদিক সেদিক খেলতাম। আহারে! কত সাধারণ দৃশ্য, কিন্তু কতইনা অসাধারণ! আব্বুর দুনিয়াটাই ছিলো তার ছেলেমেয়েরা। তাই কখনোই দেখিনি অফিসের পর অন্য কোথাও যেতে। আর আমরাও অপেক্ষায় থাকতাম কখন আব্বু আসবে অফিস থেকে আর হাতে কিছুনা কিছু থাকবেই খাওয়ার। কখনো পুরি, কখনো মিষ্টি, কখনও ফাস্ট ফুড। তারপর বানানো হতো চা। আর এরপরের দৃশ্য হলো সবাই মিলে ড্রইং রুমে বসে চা আর টা খাচ্ছি আর গল্প করছি। অবশ্য তখন টিভিও চলতো। আমাদের টিভি সবসময়ই ড্রইং রুমেই থাকতো।
আমাদের যত ফ্রেন্ডরা সবার সাথেই আমার আব্বু আম্মার অনেক ভালো সম্পর্ক ছিলো। তারা সবাই আব্বু আম্মাকে অনেক পছন্দ করতো। আমি না থাকলেও দেখা যেতো তারা আব্বু বা আম্মার সাথে গল্প করছে।
আব্বুর সাথে কোথাও বেড়াতে যাওয়া হলো সবচেয়ে আনন্দের। সারা রাস্তায়ই অনেক গল্প করবে আর খাওয়া দাওয়া। একটু পরপর চা খাওয়া হলো আব্বুর সবচেয়ে বড় অভ্যাস যেটা আমরা সব ভাইবোনই কমবেশি পেয়েছি। রাস্তার ধারে টং দোকানে চা খাওয়ার কি আনন্দ সেটা আমরা আব্বুর কাছ থেকেই শিখেছি।
সেই বাবাকে ধীরেধীরে বয়স বাড়তে দেখা, শরীরে বিভিন্ন রোগের বাসা বাঁধতে দেখা, হঠাৎ হঠাৎ কোনদিন অসুস্থ হয়ে গেলে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া এসবকিছুই দেখা একটা সন্তানের জন্য অনেক করুণ বটে আবার বাবা মায়ের এই বয়স পর্যন্ত থেকে তাদের সেবা করতে পারাটা একটা সন্তানের জন্য অনেক ভাগ্যেরও। একটা সময় তারা আমাদেরকে যেভাবে আগলে রেখেছিলেন, সময় আসে তখন তাদেরকেও একইভাবে আগলে রাখার। কেউ পারে কেউ হয়তো পারেনা। তবে অনেক কষ্টের পর সন্তানদেরকে বড় করে যখন তারা এস্টাবলিশড হয়, বাবা মায়ের জন্য কিছু করার সামর্থ্য হয় তখনই দুনিয়া থেকে চলে যাওয়াটা অন্যায়।
ছোট ছোট সাধারণ ঘটনা যা প্রতিদিনই ঘটে, কেউ জানেনা হঠাৎ করে এই দৃশ্যগুলো আর দেখা যাবেনা। যেমন আব্বুর বারান্দায় বসে পেপার পড়ার দৃশ্য, যেমন রাত আতটার খবর মনযোগ দিয়ে দেখার দৃশ্য, রাস্তার ধারে কোন ছোট্ট দোকানে আব্বুর বসে চা খাওয়ার দৃশ্য, বারান্দা থেকে নিচে তাকিয়ে রাস্তা ধরে আব্বুর হেঁটে যাওয়ার দৃশ্য এই আটপৌরে সাধারণ দৃশ্যগুলোই এখন আর কোনকিছুর বিনিময়েই পাওয়া যাবেনা। বাবারা সবসময় সন্তানদের মাথার উপর ছায়া হয়ে থাকবে, সন্তানের যেকোন বিপদে বাবা থাকলেই আর চিন্তা থাকবেনা এমনই সব সন্তান ভাবে। তারা ভাবে বাবারা কোনদিন মরে যাবেনা। কিন্তু এমনও দিন আসে যখন সন্তানের সামনে বাবার মৃতদেহ থাকে। তখন থেকেই তাদের মুখে আর কোনদিন বাবাত ডাক দেওয়ার সুযোগ থাকেনা। এটা মেনে নেওয়া যায়না। জীবন তো আর থেমে থাকেনা। কিন্তু যে বাবা চলে যায় সে আর ফিরে আসেনা, তার শুন্যস্থান কোনদিন কিছু দিয়েই আর পূর্ণ হয়না।
ইউ কে এম ফারহানা সুলতানা : লেখক,প্রকল্প ব্যবস্থাপক, আরইএসএইচ প্রজেক্ট, এএসডি
সেই অনেকদিন আগের কথা। আমরা তখন চার বোনই বাড়ির বাইরে পড়াশোনার উদ্দেশ্যে। সবাই হলে থাকি। একেকজন একেক জায়গায়। বাসায় শুধু আব্বু আম্মা আর ছোট্ট ভাইটা। একদিন আব্বু একটা বিশাল বড় মাছ নিয়ে আসলো, নদীর। তো সেই মাছ তো আর তাদের গলা দিয়ে নামছে না। মেয়েরা কেউই পাশে নেই। আর আমরা তখন কোন একটা ছুটির শেষে মাত্রই সবাই হলে ফিরেছি। সহসা আসা হবে না। তখন আম্মা মাছ রান্না করে বাটিতে করে করে দিলো আর আব্বু সেই বাটি নিয়ে কুমিল্লা থেকে ঢাকা, বগুড়া আর রাজশাহীতে মেয়েদের কাছে পৌঁছে দিলো। ব্যাপারটা অদ্ভূত।এই তুচ্ছ একটা ব্যাপারে এত কাহিনী করা! কিন্তু হয়তোবা বাবা মায়ের কাছে এগুলো অদ্ভূত না।
ছোটবেলার সবচেয়ে সুন্দর স্মৃতিগুলোর মধ্যে ছিলো আব্বুর হাত ধরে আমরা চার বোন যখন আশেপাশে বেড়াতে যেতাম। আগে বৃহস্পতিবার ছিলো হাফ অফিস আর শুক্রবার পুরো ছুটি। তখন থাকতাম ব্রাহ্মণ্ণপবাড়িয়ায়। বাসা থেকে কিছু দূরেই ছিলো একটা খাল। বৃহস্পতিবার দুপুরে খাওয়ার পরই আমরা আব্বুর সাথে চলে যেতাম সেই খালপাড়ে। আব্বু বসে থাকতো, কারোর সাথে গল্প করতো বা পেপার পড়তো আর আমরা এদিক সেদিক খেলতাম। আহারে! কত সাধারণ দৃশ্য, কিন্তু কতইনা অসাধারণ! আব্বুর দুনিয়াটাই ছিলো তার ছেলেমেয়েরা। তাই কখনোই দেখিনি অফিসের পর অন্য কোথাও যেতে। আর আমরাও অপেক্ষায় থাকতাম কখন আব্বু আসবে অফিস থেকে আর হাতে কিছুনা কিছু থাকবেই খাওয়ার। কখনো পুরি, কখনো মিষ্টি, কখনও ফাস্ট ফুড। তারপর বানানো হতো চা। আর এরপরের দৃশ্য হলো সবাই মিলে ড্রইং রুমে বসে চা আর টা খাচ্ছি আর গল্প করছি। অবশ্য তখন টিভিও চলতো। আমাদের টিভি সবসময়ই ড্রইং রুমেই থাকতো।
আমাদের যত ফ্রেন্ডরা সবার সাথেই আমার আব্বু আম্মার অনেক ভালো সম্পর্ক ছিলো। তারা সবাই আব্বু আম্মাকে অনেক পছন্দ করতো। আমি না থাকলেও দেখা যেতো তারা আব্বু বা আম্মার সাথে গল্প করছে।
আব্বুর সাথে কোথাও বেড়াতে যাওয়া হলো সবচেয়ে আনন্দের। সারা রাস্তায়ই অনেক গল্প করবে আর খাওয়া দাওয়া। একটু পরপর চা খাওয়া হলো আব্বুর সবচেয়ে বড় অভ্যাস যেটা আমরা সব ভাইবোনই কমবেশি পেয়েছি। রাস্তার ধারে টং দোকানে চা খাওয়ার কি আনন্দ সেটা আমরা আব্বুর কাছ থেকেই শিখেছি।
সেই বাবাকে ধীরেধীরে বয়স বাড়তে দেখা, শরীরে বিভিন্ন রোগের বাসা বাঁধতে দেখা, হঠাৎ হঠাৎ কোনদিন অসুস্থ হয়ে গেলে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া এসবকিছুই দেখা একটা সন্তানের জন্য অনেক করুণ বটে আবার বাবা মায়ের এই বয়স পর্যন্ত থেকে তাদের সেবা করতে পারাটা একটা সন্তানের জন্য অনেক ভাগ্যেরও। একটা সময় তারা আমাদেরকে যেভাবে আগলে রেখেছিলেন, সময় আসে তখন তাদেরকেও একইভাবে আগলে রাখার। কেউ পারে কেউ হয়তো পারেনা। তবে অনেক কষ্টের পর সন্তানদেরকে বড় করে যখন তারা এস্টাবলিশড হয়, বাবা মায়ের জন্য কিছু করার সামর্থ্য হয় তখনই দুনিয়া থেকে চলে যাওয়াটা অন্যায়।
ছোট ছোট সাধারণ ঘটনা যা প্রতিদিনই ঘটে, কেউ জানেনা হঠাৎ করে এই দৃশ্যগুলো আর দেখা যাবেনা। যেমন আব্বুর বারান্দায় বসে পেপার পড়ার দৃশ্য, যেমন রাত আতটার খবর মনযোগ দিয়ে দেখার দৃশ্য, রাস্তার ধারে কোন ছোট্ট দোকানে আব্বুর বসে চা খাওয়ার দৃশ্য, বারান্দা থেকে নিচে তাকিয়ে রাস্তা ধরে আব্বুর হেঁটে যাওয়ার দৃশ্য এই আটপৌরে সাধারণ দৃশ্যগুলোই এখন আর কোনকিছুর বিনিময়েই পাওয়া যাবেনা। বাবারা সবসময় সন্তানদের মাথার উপর ছায়া হয়ে থাকবে, সন্তানের যেকোন বিপদে বাবা থাকলেই আর চিন্তা থাকবেনা এমনই সব সন্তান ভাবে। তারা ভাবে বাবারা কোনদিন মরে যাবেনা। কিন্তু এমনও দিন আসে যখন সন্তানের সামনে বাবার মৃতদেহ থাকে। তখন থেকেই তাদের মুখে আর কোনদিন বাবাত ডাক দেওয়ার সুযোগ থাকেনা। এটা মেনে নেওয়া যায়না। জীবন তো আর থেমে থাকেনা। কিন্তু যে বাবা চলে যায় সে আর ফিরে আসেনা, তার শুন্যস্থান কোনদিন কিছু দিয়েই আর পূর্ণ হয়না।
ইউ কে এম ফারহানা সুলতানা : লেখক,প্রকল্প ব্যবস্থাপক, আরইএসএইচ প্রজেক্ট, এএসডি