মো. মহিউদ্দিন লিটন
আনন্দ ও বিনোদন থেকে বঞ্চিত শিক্ষা জন্ম দেয় যান্ত্রিক, মুখস্থনির্ভর এবং আত্মবিশ্বাসহীন এক প্রজন্ম। বর্তমান বিশ্বের পরিবর্তনশীল সমাজে শিক্ষার মৌলিক উদ্দেশ্য কেবল তথ্য অর্জন কিংবা পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করা নয়। বরং শিক্ষা হওয়া উচিত একটি আনন্দময়, চিন্তাশীল, সৃজনশীল এবং মানবিক বিকাশের কেন্দ্র। আনন্দ ও কৌতূহলবোধ হচ্ছে শেখার প্রকৃত অনুপ্রেরণা। যে শিক্ষার্থী আনন্দ নিয়ে শেখে, সে বিষয়বস্তুকে হৃদয়ঙ্গম করতে পারে সহজে এবং স্থায়ীভাবে অন্যদিকে, জোরপূর্বক চাপিয়ে দেওয়া শিক্ষা কেবল মুখস্থবিদ্যায় পরিণত হয়, যা পরীক্ষার পর পরই ভুলে যাওয়া স্বাভাবিক।
শিক্ষা জীবনের মৌলিক ভিত্তি, যার মাধ্যমে গড়ে ওঠে একটি জাতির ভবিষ্যৎ। কিন্তু সেই শিক্ষা যদি হয় কেবল বই মুখস্থ ও নম্বর নির্ভরতা এবং পরীক্ষায় ভালো ফল করার দৌড়, তাহলে তা শিক্ষার্থীদের জন্য হয়ে দাঁড়ায় এক প্রকার মানসিক চাপ। কারণ এই শিক্ষায় নেই আনন্দ, নেই কল্পনার স্বাধীনতা বা সৃজনশীল চর্চা। অথচ প্রকৃত শিক্ষা হওয়া উচিত এমন একটি প্রক্রিয়া, যেখানে শেখার আনন্দ থাকবে, কৌতূহল থাকবে, থাকবে আত্মপ্রকাশের স্বতঃস্ফূর্ততা।
বিশ্বের অনেক উন্নত দেশেই শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠেছে আনন্দ, খেলা ও সৃজনশীলতার ভিত্তিতে। ফিনল্যান্ড, জাপান বা নেদারল্যান্ডসের মতো দেশে শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষায় খেলাধুলা, নাটক, সংগীত, ছবি আঁকা, প্রকৃতির সঙ্গে পরিচয় এসবের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। তারা বিশ্বাস করে, শিশুদের মনোজগতে আনন্দ না আনলে জ্ঞান গ্রহণের প্রক্রিয়া কার্যকর হয় না। শেখার সময় শিশু যদি মজা পায়, তাহলে সে পড়াশোনার প্রতি ভালোবাসা তৈরি করতে পারে।
সহশিক্ষা কার্যক্রম শিক্ষার্থীদের মধ্যে সামাজিক দায়িত্বশীলতার বোধও জাগায়। স্কাউট, রেড ক্রিসেন্ট, বিএনসিসি, রোটারীর মাধ্যমে রক্তদান কর্মসূচি, বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি, মানবিক এবং সামাজিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ শিক্ষার্থীদের সমাজের প্রতি দায়িত্বশীল মানবিক মানুষ হতে শেখায়। এতে শিক্ষার্থীরা সমাজের প্রতি তাদের দায়িত্ব পালন করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে এবং তাদের মধ্যে মানবিক গুণাবলির বিকাশ ঘটে। তবে সহশিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ শুধু সাফল্য এনে দেয় না, এটি শিক্ষার্থীদের জীবনকে আনন্দময় করে তোলে।
শিক্ষার্থীরা যখন তাদের পছন্দের কার্যক্রমে সময় দেয়, তখন তাদের মন আনন্দে ভরে ওঠে। তাছাড়া সহশিক্ষা কার্যক্রম শিক্ষার্থীদের একঘেয়েমি থেকে মুক্তি দেয়, যা তাদের শিক্ষাজীবনের গুণগত মান উন্নত করতে সহায়ক। শিক্ষা ব্যবস্থায় সহশিক্ষা কার্যক্রম একটি অপরিহার্য অংশ। এটি শিক্ষার্থীদের জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাফল্যের পথে পরিচালিত করে।
শিক্ষার্থীরা যাতে সহশিক্ষা কার্যক্রমে আরো বেশি অংশ নিতে পারে, সেই সুযোগ সৃষ্টি করা এবং এ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সহশিক্ষা কার্যক্রম শুধু শিক্ষার একটি অঙ্গ নয়, বরং শিক্ষার্থীদের জীবন ও ব্যক্তিত্ব গঠনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। পাঠ্যবইয়ের বাইরের এই কার্যক্রম তাদেরকে জীবনমুখী, দক্ষ, এবং পরিপূর্ণ একজন মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে। এজন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে সহশিক্ষা কার্যক্রমে আরও বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত এবং অভিভাবকদেরও তাদের সন্তানদের এই কার্যক্রমে উৎসাহিত করা যেতে পারে
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শিক্ষাব্যবস্থাটি এখনো অনেকাংশে মুখস্থনির্ভর, পরীক্ষাভিত্তিক। শিক্ষার্থীদের সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত ক্লাস, এরপর কোচিং, হোমওয়ার্ক এবং পরীক্ষার প্রস্তুতিতে সময় কাটে। তাদের মনে আনন্দ বা সৃজনশীল চর্চার সুযোগ প্রায় থাকে না বললেই চলে। ফলে শিক্ষার্থীরা একসময় পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ ও মনোযোগ হারিয়ে ফেলে। তারা শেখে শুধু পাশ করার জন্য, শেখে না জানার জন্য।
শিশুরা প্রাকৃতিকভাবে কল্পনাপ্রবণ। তারা খেলে, প্রশ্ন করে, কৌতূহল নিয়ে জগৎকে আবিষ্কার করতে চায়। কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থায় যদি সেই কৌতূহলকে দমন করা হয়, যদি শুধু মুখস্থ বিদ্যাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়, তবে সেই শিশু তার মেধা বিকাশের সুযোগ পায় না। তার মন বিষণ্ণ ও ক্লান্ত হয়ে পড়ে। শুধু শিক্ষার্থীরাই নয়, শিক্ষক ও অভিভাবকদের ভূমিকাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একজন শিক্ষক যদি শুধু পড়া ধরেন, বকাঝকা করেন এবং শাস্তি দেন, তাহলে শিক্ষার্থীর মধ্যে জ্ঞানার্জনের আগত জন্মায় না। বরং পাঠদানকে আনন্দদায়ক করে তোলেন, গল্পের মতো করে বিষয় উপস্থাপন করেন, উদাহরণ দিয়ে শেখান, তাহলে শিক্ষার্থীরা সহজে মনোযোগী হয় এবং শেখার আগ্রহ তৈরি হয়।
অভিভাবকদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। তারা শুধু ফলাফল ও গ্রেডের পেছনে ছুটতে থাকেন। সন্তান কত নাম্বার পেল, কোন পজিশনে আছে—এসবেই সন্তুষ্টি খোঁজেন। অথচ সন্তানের মানসিক আনন্দ, সৃজনশীলতা বা নৈতিক বিকাশের দিকে নজর দেন না। এতে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনাকে একটি বোঝা হিসেবে গ্রহণ করে।
আনন্দময় শিক্ষা মানে শুধু খেলাধুলা বা মজার গল্প বলা নয়। এটি একটি পরিপূর্ণ শিক্ষা দর্শন, যেখানে পাঠ্যপুস্তকের পাশাপাশি সহপাঠ্যক্রমিক কার্যক্রম; যেমন—খেলাধুলা, গান, নাটক, চিত্রাঙ্কন, প্রকল্পভিত্তিক কাজ, বিতর্ক ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত থাকে। স্কুলে যদি সপ্তাহে একদিন ঘন্টা দুয়েক সময় খেলাধুলা, গান—বাজনা, গল্প বা শিয় শিল্পচর্চার জন্য নির্ধারিত থাকে, তাহলে শিক্ষার্থীরা মানসিকভাবে চাঙ্গা থাকবে। তাদের মধ্যে বিরক্তি আসবে না, শেখার প্রতি ভালোবাসা তৈরি হবে। খেলাধুলা শুধু শরীরচর্চা নয়—এটি দলবদ্ধতা, নেতৃত্ব, শৃঙ্খলা এবং মনোবল গঠনের প্রশিক্ষণও বটে।
প্রযুক্তির সাহায্যে শিক্ষাকে আরো আনন্দদায়ক করে তোলা যায়। অডিও—ভিজ্যুয়াল প্রেজেন্টেশন, অ্যানিমেশন, ইন্টারঅ্যাকটিভভার্চুয়াল গেম, ক্লাসরুম—এসব ব্যবহারে শিশুরা বেশি আগ্রহী হয়ে ওঠে। আমাদের দেশের অনেক স্কুলে এখন মালটিমিডিয়া ক্লাসরুম চালু হয়েছে, কিন্তু তা ব্যবহার হয় খুব সীমিত আকারে। এই এই প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার শিক্ষা কার্যক্রমে আনন্দ বাড়াতে পারে বহুগুণে।
আনন্দ ও সৃজনশীলতাহীন শিক্ষার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবও ভয়াবহ। শিক্ষার্থীরা কেবল সার্টিফিকেট অর্জন করে, কিন্তু তারা সমাজে একজন চিন্তাশীল, মানবিক ও দক্ষ নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে পারে না। তাদের মধ্যে থাকে না কর্মপ্রেরণা, আত্মবিশ্বাস বা নেতৃত্বগুণ।
শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, এনজিও, শিক্ষা উদ্যোক্তা ও গণমাধ্যমকে একযোগে কাজ করতে হবে। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণে আনন্দভিত্তিক পাঠদানের কৌশল অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। একই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের মতামত, আগ্রহ ও স্বপ্নকে সম্মান জানিয়ে সেই অনুযায়ী পাঠ্যবিষয় নির্বাচন এবং উপস্থাপন করতে হবে।
আমরা যদি একটি উদ্ভাবনী, সৃজনশীল ও আনন্দময় প্রজন্ম গড়ে তুলতে চাই, তাহলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় আনন্দ, কল্পনা ও বাস্তবমুখী শিক্ষার অনুষঙ্গ যোগ করার প্রয়োজন। আমরা যদি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে এখন আনন্দঘন মুহূর্ত করে তুলতে না পারি, তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কখনো প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারবে না। রুটিন মাফিক মুখস্থ শিক্ষা মানুষকে একটি গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখে এবং শিক্ষার প্রতি ছাত্রছাত্রীদের অনীহা সৃষ্ট করে।
মো. মহিউদ্দিন লিটন, প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ, কুমিল্লা আইডিয়াল কলেজ, বাগিচাগাও, কুমিল্লা।
আনন্দ ও বিনোদন থেকে বঞ্চিত শিক্ষা জন্ম দেয় যান্ত্রিক, মুখস্থনির্ভর এবং আত্মবিশ্বাসহীন এক প্রজন্ম। বর্তমান বিশ্বের পরিবর্তনশীল সমাজে শিক্ষার মৌলিক উদ্দেশ্য কেবল তথ্য অর্জন কিংবা পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করা নয়। বরং শিক্ষা হওয়া উচিত একটি আনন্দময়, চিন্তাশীল, সৃজনশীল এবং মানবিক বিকাশের কেন্দ্র। আনন্দ ও কৌতূহলবোধ হচ্ছে শেখার প্রকৃত অনুপ্রেরণা। যে শিক্ষার্থী আনন্দ নিয়ে শেখে, সে বিষয়বস্তুকে হৃদয়ঙ্গম করতে পারে সহজে এবং স্থায়ীভাবে অন্যদিকে, জোরপূর্বক চাপিয়ে দেওয়া শিক্ষা কেবল মুখস্থবিদ্যায় পরিণত হয়, যা পরীক্ষার পর পরই ভুলে যাওয়া স্বাভাবিক।
শিক্ষা জীবনের মৌলিক ভিত্তি, যার মাধ্যমে গড়ে ওঠে একটি জাতির ভবিষ্যৎ। কিন্তু সেই শিক্ষা যদি হয় কেবল বই মুখস্থ ও নম্বর নির্ভরতা এবং পরীক্ষায় ভালো ফল করার দৌড়, তাহলে তা শিক্ষার্থীদের জন্য হয়ে দাঁড়ায় এক প্রকার মানসিক চাপ। কারণ এই শিক্ষায় নেই আনন্দ, নেই কল্পনার স্বাধীনতা বা সৃজনশীল চর্চা। অথচ প্রকৃত শিক্ষা হওয়া উচিত এমন একটি প্রক্রিয়া, যেখানে শেখার আনন্দ থাকবে, কৌতূহল থাকবে, থাকবে আত্মপ্রকাশের স্বতঃস্ফূর্ততা।
বিশ্বের অনেক উন্নত দেশেই শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠেছে আনন্দ, খেলা ও সৃজনশীলতার ভিত্তিতে। ফিনল্যান্ড, জাপান বা নেদারল্যান্ডসের মতো দেশে শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষায় খেলাধুলা, নাটক, সংগীত, ছবি আঁকা, প্রকৃতির সঙ্গে পরিচয় এসবের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। তারা বিশ্বাস করে, শিশুদের মনোজগতে আনন্দ না আনলে জ্ঞান গ্রহণের প্রক্রিয়া কার্যকর হয় না। শেখার সময় শিশু যদি মজা পায়, তাহলে সে পড়াশোনার প্রতি ভালোবাসা তৈরি করতে পারে।
সহশিক্ষা কার্যক্রম শিক্ষার্থীদের মধ্যে সামাজিক দায়িত্বশীলতার বোধও জাগায়। স্কাউট, রেড ক্রিসেন্ট, বিএনসিসি, রোটারীর মাধ্যমে রক্তদান কর্মসূচি, বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি, মানবিক এবং সামাজিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ শিক্ষার্থীদের সমাজের প্রতি দায়িত্বশীল মানবিক মানুষ হতে শেখায়। এতে শিক্ষার্থীরা সমাজের প্রতি তাদের দায়িত্ব পালন করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে এবং তাদের মধ্যে মানবিক গুণাবলির বিকাশ ঘটে। তবে সহশিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ শুধু সাফল্য এনে দেয় না, এটি শিক্ষার্থীদের জীবনকে আনন্দময় করে তোলে।
শিক্ষার্থীরা যখন তাদের পছন্দের কার্যক্রমে সময় দেয়, তখন তাদের মন আনন্দে ভরে ওঠে। তাছাড়া সহশিক্ষা কার্যক্রম শিক্ষার্থীদের একঘেয়েমি থেকে মুক্তি দেয়, যা তাদের শিক্ষাজীবনের গুণগত মান উন্নত করতে সহায়ক। শিক্ষা ব্যবস্থায় সহশিক্ষা কার্যক্রম একটি অপরিহার্য অংশ। এটি শিক্ষার্থীদের জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাফল্যের পথে পরিচালিত করে।
শিক্ষার্থীরা যাতে সহশিক্ষা কার্যক্রমে আরো বেশি অংশ নিতে পারে, সেই সুযোগ সৃষ্টি করা এবং এ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সহশিক্ষা কার্যক্রম শুধু শিক্ষার একটি অঙ্গ নয়, বরং শিক্ষার্থীদের জীবন ও ব্যক্তিত্ব গঠনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। পাঠ্যবইয়ের বাইরের এই কার্যক্রম তাদেরকে জীবনমুখী, দক্ষ, এবং পরিপূর্ণ একজন মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে। এজন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে সহশিক্ষা কার্যক্রমে আরও বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত এবং অভিভাবকদেরও তাদের সন্তানদের এই কার্যক্রমে উৎসাহিত করা যেতে পারে
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শিক্ষাব্যবস্থাটি এখনো অনেকাংশে মুখস্থনির্ভর, পরীক্ষাভিত্তিক। শিক্ষার্থীদের সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত ক্লাস, এরপর কোচিং, হোমওয়ার্ক এবং পরীক্ষার প্রস্তুতিতে সময় কাটে। তাদের মনে আনন্দ বা সৃজনশীল চর্চার সুযোগ প্রায় থাকে না বললেই চলে। ফলে শিক্ষার্থীরা একসময় পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ ও মনোযোগ হারিয়ে ফেলে। তারা শেখে শুধু পাশ করার জন্য, শেখে না জানার জন্য।
শিশুরা প্রাকৃতিকভাবে কল্পনাপ্রবণ। তারা খেলে, প্রশ্ন করে, কৌতূহল নিয়ে জগৎকে আবিষ্কার করতে চায়। কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থায় যদি সেই কৌতূহলকে দমন করা হয়, যদি শুধু মুখস্থ বিদ্যাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়, তবে সেই শিশু তার মেধা বিকাশের সুযোগ পায় না। তার মন বিষণ্ণ ও ক্লান্ত হয়ে পড়ে। শুধু শিক্ষার্থীরাই নয়, শিক্ষক ও অভিভাবকদের ভূমিকাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একজন শিক্ষক যদি শুধু পড়া ধরেন, বকাঝকা করেন এবং শাস্তি দেন, তাহলে শিক্ষার্থীর মধ্যে জ্ঞানার্জনের আগত জন্মায় না। বরং পাঠদানকে আনন্দদায়ক করে তোলেন, গল্পের মতো করে বিষয় উপস্থাপন করেন, উদাহরণ দিয়ে শেখান, তাহলে শিক্ষার্থীরা সহজে মনোযোগী হয় এবং শেখার আগ্রহ তৈরি হয়।
অভিভাবকদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। তারা শুধু ফলাফল ও গ্রেডের পেছনে ছুটতে থাকেন। সন্তান কত নাম্বার পেল, কোন পজিশনে আছে—এসবেই সন্তুষ্টি খোঁজেন। অথচ সন্তানের মানসিক আনন্দ, সৃজনশীলতা বা নৈতিক বিকাশের দিকে নজর দেন না। এতে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনাকে একটি বোঝা হিসেবে গ্রহণ করে।
আনন্দময় শিক্ষা মানে শুধু খেলাধুলা বা মজার গল্প বলা নয়। এটি একটি পরিপূর্ণ শিক্ষা দর্শন, যেখানে পাঠ্যপুস্তকের পাশাপাশি সহপাঠ্যক্রমিক কার্যক্রম; যেমন—খেলাধুলা, গান, নাটক, চিত্রাঙ্কন, প্রকল্পভিত্তিক কাজ, বিতর্ক ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত থাকে। স্কুলে যদি সপ্তাহে একদিন ঘন্টা দুয়েক সময় খেলাধুলা, গান—বাজনা, গল্প বা শিয় শিল্পচর্চার জন্য নির্ধারিত থাকে, তাহলে শিক্ষার্থীরা মানসিকভাবে চাঙ্গা থাকবে। তাদের মধ্যে বিরক্তি আসবে না, শেখার প্রতি ভালোবাসা তৈরি হবে। খেলাধুলা শুধু শরীরচর্চা নয়—এটি দলবদ্ধতা, নেতৃত্ব, শৃঙ্খলা এবং মনোবল গঠনের প্রশিক্ষণও বটে।
প্রযুক্তির সাহায্যে শিক্ষাকে আরো আনন্দদায়ক করে তোলা যায়। অডিও—ভিজ্যুয়াল প্রেজেন্টেশন, অ্যানিমেশন, ইন্টারঅ্যাকটিভভার্চুয়াল গেম, ক্লাসরুম—এসব ব্যবহারে শিশুরা বেশি আগ্রহী হয়ে ওঠে। আমাদের দেশের অনেক স্কুলে এখন মালটিমিডিয়া ক্লাসরুম চালু হয়েছে, কিন্তু তা ব্যবহার হয় খুব সীমিত আকারে। এই এই প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার শিক্ষা কার্যক্রমে আনন্দ বাড়াতে পারে বহুগুণে।
আনন্দ ও সৃজনশীলতাহীন শিক্ষার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবও ভয়াবহ। শিক্ষার্থীরা কেবল সার্টিফিকেট অর্জন করে, কিন্তু তারা সমাজে একজন চিন্তাশীল, মানবিক ও দক্ষ নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে পারে না। তাদের মধ্যে থাকে না কর্মপ্রেরণা, আত্মবিশ্বাস বা নেতৃত্বগুণ।
শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, এনজিও, শিক্ষা উদ্যোক্তা ও গণমাধ্যমকে একযোগে কাজ করতে হবে। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণে আনন্দভিত্তিক পাঠদানের কৌশল অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। একই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের মতামত, আগ্রহ ও স্বপ্নকে সম্মান জানিয়ে সেই অনুযায়ী পাঠ্যবিষয় নির্বাচন এবং উপস্থাপন করতে হবে।
আমরা যদি একটি উদ্ভাবনী, সৃজনশীল ও আনন্দময় প্রজন্ম গড়ে তুলতে চাই, তাহলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় আনন্দ, কল্পনা ও বাস্তবমুখী শিক্ষার অনুষঙ্গ যোগ করার প্রয়োজন। আমরা যদি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে এখন আনন্দঘন মুহূর্ত করে তুলতে না পারি, তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কখনো প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারবে না। রুটিন মাফিক মুখস্থ শিক্ষা মানুষকে একটি গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখে এবং শিক্ষার প্রতি ছাত্রছাত্রীদের অনীহা সৃষ্ট করে।
মো. মহিউদ্দিন লিটন, প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ, কুমিল্লা আইডিয়াল কলেজ, বাগিচাগাও, কুমিল্লা।