শ্রদ্ধাঞ্জলি
সজীব রায় চৌধুরী
রমেশ চন্দ্র রায় চৌধুরী। আমার দাদু। আজ থেকে ২৭ বছর আগে এই দিনে (১৩ জুন) তিনি পরলোকগমন করেন। কুমিল্লা নগরের চকবাজার এলাকার মানুষের নানা ধরনের কাজ করেছেন তিনি। বিলুপ্ত কুমিল্লা পৌরসভার দুইবারের কাউন্সিলর ছিলেন। সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও স্বেচ্ছাসেবী নানা কাজে তিনি ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। নাটকে অভিনয় করতেন। ভার্নাল থিয়েটারের সক্রিয় নেতা ও সংগঠক ছিলেন। ছাত্রজীবন থেকে তিনি অদম্য সাহসী ও প্রতিবাদী ছিলেন। অন্যায় অনাচারের বিরুদ্ধে তিনি আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিলেন।
দাদুর সঙ্গে আমার অনেক স্মৃতি। প্রতি বছর পহেলা বৈশাখে তিনি আমাদেরকে নিয়ে মেলায় আসতেন। মাছ, তরমুজ ও বিভিন্ন ধরণের খেলনা কিনে দিতেন। বাসায় আমরা একসঙ্গে খেতে বসলাম। দাদুকে সবাইকে নিয়ে খেতে বসতে পছন্দ করতেন। আমাকে অসম্ভব আদর করতেন। আমার মাথার চুল লাল হওয়ায় আমাকে ‘সাহেব’ বলে ডাকতেন। তাঁর গলা ছিল ভরাট। বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর ছিল তাঁর। আমাদের সঙ্গে তাঁর ছিল হরিহর আত্নার সম্পর্ক।
আমার দাদুর বাড়ি অবিভক্ত কুমিল্লার চাঁদপুর জেলায়। ১৯১২ সালে চাঁদপুর জেলার সদর উপজেলার চরবাকিলা গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারে তাঁর জন্ম। দাদুর বাবার নাম ছিল রাজ চন্দ্র রায় চৌধুরী ( রাজাবাবু নামে পরিচিতি ছিল তাঁর) ও মায়ের নাম সারদা সুন্দরী রায় চৌধুরী। রমেশ দাদুর শৈশব কেটেছে চাঁদপুরের চরবাকিলা গ্রামে। তিনি ছিলেন রাজ ও সারদা সুন্দরীর একমাত্র সন্তান। ছাত্রজীবন থেকে তিনি নানা ধরনের আন্দোলন সংগ্রামে জড়িয়ে পড়েন। তখন হিন্দু বিধবা বিবাহ আন্দোলন চলছিল চাঁদপুরেও। সেই আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন আমার দাদু। তখন এক হিন্দু বিধবা নারীকে বিবাহ দেন আন্দোলনকারীরা। এই সময়ে সেখানকার কয়েকজন হিন্দু তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত হন। এক পর্যায়ে তিনি কুমিল্লায় চলে আসেন। এখানেও কিছুদিন তিনি আন্দোলনে যুক্ত হন। এরপর তিনি কয়েকমাস আসামে ছিলেন। পরে কুমিল্লায় এসে ব্যবসায় যুক্ত হন। মুদি মালের ব্যবসা। তিনি ঠিকাদারিও করতেন।
আমার দাদুর ছয় সন্তান। এর মধ্যে তিন ছেলে ও তিন মেয়ে। বড় ছেলে রণজিত রায় চৌধুরী, মেজ ছেলে সনজিত রায় চৌধুরী ও ছোট ছেলে অভিজিত রায় চৌধুরী । তিনি মেয়ে হলেন মঞ্জু রাণী সাহা, মমতা রাণী সাহা ও নমিতা রাণী সাহা। তাঁর তিন মেয়ে বড়। তিন মেয়ের পর তিনি ছেলে। আমার বাবা রনজিত রায় চৌধুরী ভাইদের মধ্যে বড়। দ্বিতীয় সনজিত রায় চৌধুরী জাতীয়তাবাদী হিন্দু দলের কুমিল্লা জেলার প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি ছিলেন। তিনি গত হয়েছেন ২০২১ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর। আমাদের যৌথ পরিবার। এখনও সবাই একই পাতিলের তৈরি খাবার খাচ্ছি। বাপ-চাচারা সবাই একসঙ্গে আছি। ভাইবোনেরা আছি।
রমেশ চন্দ্র রায় চৌধুরীর বিশাল কর্মযজ্ঞ ছিল। তিনি পাকিস্তান আমলে বিডি সদস্য ছিলেন। সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নাট্য সংগঠন বৃটিশ শাসনামলের ঐতিহ্যবাহী ভার্নাল থিয়েটারের সহসভাপতি ছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কুমিল্লা পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ড (বর্তমানে ৬ নং ওয়ার্ডের) কমিশনার ছিলেন। দুইবার কমিশনার ছিলেন। কমিশনার হিসেবে তিনি ছিলেন ন্যায় বিচারক। বিচার করতেন ন্যায়সঙ্গতভাবে। চকবাজার ও তেরিপট্রি এলাকার মানুষ তাঁকে প্রচণ্ড ভালোবাসতেন। শ্রদ্ধা করতেন।
তিনি জগন্নাথবাড়ি কার্যকরি কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। রথ উৎসবের ‘দেওয়ানজী ’ ছিলেন। চকবাজার গ্রোচারী মার্চেন্ট সমিতির উপদেষ্টা ছিলেন। টিক্কারচর মহাশ্মশানের সভাপতি ছিলেন দীর্ঘদিন। চকবাজার সিদ্ধেশ্বরী কালীবাড়ি মন্দিরের সভাপতি ছিলেন। জনপ্রতিনিধি ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ী হিসেবে তাঁর এলাকায় প্রভাব ছিল। তিনি ওই সময়ে বিভিন্ন পদে থাকায় বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা রক্ষা পেয়েছে। দখলের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে।
প্রতিবছর একবার আমরা চাঁদপুরের দাদুর গ্রামের বাড়িতে যাই। উৎসবে অংশ নিই। আমার ঠাকুরমা স্নেহলতা রায় চৌধুরাণী সোনারগাঁয়ের পানাম নগরীর জমিদার বংশের মেয়ে ছিলেন। দাদুর মৃত্যুর আটবছর পর ঠাকুরমাও মারা যান।
রমেশ চন্দ্র রায় চৌধুরীর প্রতিষ্ঠিত মেসার্স রমেশ রায় চৌধুরী মুদি দোকানই আমাদেরই কর্মক্ষেত্র। এগিয়ে চলা। দাদুর জায়গায় এখন মৈত্রী ভবন। সেখানে আমাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। উনার পরিচয়েই বেঁচে আছি।
দাদুর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে তাঁর প্রতিষ্ঠিত মন্দিরে আজ রাত আটটার পরে প্রার্থনা ও রাত প্রসাদ বিতরণ করা হবে।
রমেশ চন্দ্র রায় চৌধুরী ছিলেন ক্ষণজন্মা পুরুষ। চলনে বলনে তিনি ছিলেন অসাধারণ। মানবের কল্যাণে কাজ করেছেন আমৃত্যু। সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে পরিশ্রম করে তিনি এগিয়ে যান। কুমিল্লা নগরের মানুষ এখনও তাঁকে স্মরণ করে। আমাদের পথচলায় তিনি অহর্নিশ আছেন। প্রতিদিন কোন না কোনভাবে তাঁকে স্মরণ করি। তাঁর বিশাল কর্মকে উপলব্ধি করি। তাঁর দৃষ্টান্ত হতে চাই। কৈশোরে দাদুকে হারাই। কিন্তু তাঁর অপত্য স্নেহ এখনও মনে পড়ে। কত দুষ্টুমি, খুঁনসুটি ও আনন্দযজ্ঞে মেতেছিলাম দাদু আর আমি। অতল শ্রদ্ধা দাদু।
সজীব রায় চৌধুরী: ব্যবসায়ী ও রমেশ চন্দ্র রায় চৌধুরীর নাতি।
রমেশ চন্দ্র রায় চৌধুরী। আমার দাদু। আজ থেকে ২৭ বছর আগে এই দিনে (১৩ জুন) তিনি পরলোকগমন করেন। কুমিল্লা নগরের চকবাজার এলাকার মানুষের নানা ধরনের কাজ করেছেন তিনি। বিলুপ্ত কুমিল্লা পৌরসভার দুইবারের কাউন্সিলর ছিলেন। সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও স্বেচ্ছাসেবী নানা কাজে তিনি ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। নাটকে অভিনয় করতেন। ভার্নাল থিয়েটারের সক্রিয় নেতা ও সংগঠক ছিলেন। ছাত্রজীবন থেকে তিনি অদম্য সাহসী ও প্রতিবাদী ছিলেন। অন্যায় অনাচারের বিরুদ্ধে তিনি আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিলেন।
দাদুর সঙ্গে আমার অনেক স্মৃতি। প্রতি বছর পহেলা বৈশাখে তিনি আমাদেরকে নিয়ে মেলায় আসতেন। মাছ, তরমুজ ও বিভিন্ন ধরণের খেলনা কিনে দিতেন। বাসায় আমরা একসঙ্গে খেতে বসলাম। দাদুকে সবাইকে নিয়ে খেতে বসতে পছন্দ করতেন। আমাকে অসম্ভব আদর করতেন। আমার মাথার চুল লাল হওয়ায় আমাকে ‘সাহেব’ বলে ডাকতেন। তাঁর গলা ছিল ভরাট। বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর ছিল তাঁর। আমাদের সঙ্গে তাঁর ছিল হরিহর আত্নার সম্পর্ক।
আমার দাদুর বাড়ি অবিভক্ত কুমিল্লার চাঁদপুর জেলায়। ১৯১২ সালে চাঁদপুর জেলার সদর উপজেলার চরবাকিলা গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারে তাঁর জন্ম। দাদুর বাবার নাম ছিল রাজ চন্দ্র রায় চৌধুরী ( রাজাবাবু নামে পরিচিতি ছিল তাঁর) ও মায়ের নাম সারদা সুন্দরী রায় চৌধুরী। রমেশ দাদুর শৈশব কেটেছে চাঁদপুরের চরবাকিলা গ্রামে। তিনি ছিলেন রাজ ও সারদা সুন্দরীর একমাত্র সন্তান। ছাত্রজীবন থেকে তিনি নানা ধরনের আন্দোলন সংগ্রামে জড়িয়ে পড়েন। তখন হিন্দু বিধবা বিবাহ আন্দোলন চলছিল চাঁদপুরেও। সেই আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন আমার দাদু। তখন এক হিন্দু বিধবা নারীকে বিবাহ দেন আন্দোলনকারীরা। এই সময়ে সেখানকার কয়েকজন হিন্দু তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত হন। এক পর্যায়ে তিনি কুমিল্লায় চলে আসেন। এখানেও কিছুদিন তিনি আন্দোলনে যুক্ত হন। এরপর তিনি কয়েকমাস আসামে ছিলেন। পরে কুমিল্লায় এসে ব্যবসায় যুক্ত হন। মুদি মালের ব্যবসা। তিনি ঠিকাদারিও করতেন।
আমার দাদুর ছয় সন্তান। এর মধ্যে তিন ছেলে ও তিন মেয়ে। বড় ছেলে রণজিত রায় চৌধুরী, মেজ ছেলে সনজিত রায় চৌধুরী ও ছোট ছেলে অভিজিত রায় চৌধুরী । তিনি মেয়ে হলেন মঞ্জু রাণী সাহা, মমতা রাণী সাহা ও নমিতা রাণী সাহা। তাঁর তিন মেয়ে বড়। তিন মেয়ের পর তিনি ছেলে। আমার বাবা রনজিত রায় চৌধুরী ভাইদের মধ্যে বড়। দ্বিতীয় সনজিত রায় চৌধুরী জাতীয়তাবাদী হিন্দু দলের কুমিল্লা জেলার প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি ছিলেন। তিনি গত হয়েছেন ২০২১ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর। আমাদের যৌথ পরিবার। এখনও সবাই একই পাতিলের তৈরি খাবার খাচ্ছি। বাপ-চাচারা সবাই একসঙ্গে আছি। ভাইবোনেরা আছি।
রমেশ চন্দ্র রায় চৌধুরীর বিশাল কর্মযজ্ঞ ছিল। তিনি পাকিস্তান আমলে বিডি সদস্য ছিলেন। সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নাট্য সংগঠন বৃটিশ শাসনামলের ঐতিহ্যবাহী ভার্নাল থিয়েটারের সহসভাপতি ছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কুমিল্লা পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ড (বর্তমানে ৬ নং ওয়ার্ডের) কমিশনার ছিলেন। দুইবার কমিশনার ছিলেন। কমিশনার হিসেবে তিনি ছিলেন ন্যায় বিচারক। বিচার করতেন ন্যায়সঙ্গতভাবে। চকবাজার ও তেরিপট্রি এলাকার মানুষ তাঁকে প্রচণ্ড ভালোবাসতেন। শ্রদ্ধা করতেন।
তিনি জগন্নাথবাড়ি কার্যকরি কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। রথ উৎসবের ‘দেওয়ানজী ’ ছিলেন। চকবাজার গ্রোচারী মার্চেন্ট সমিতির উপদেষ্টা ছিলেন। টিক্কারচর মহাশ্মশানের সভাপতি ছিলেন দীর্ঘদিন। চকবাজার সিদ্ধেশ্বরী কালীবাড়ি মন্দিরের সভাপতি ছিলেন। জনপ্রতিনিধি ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ী হিসেবে তাঁর এলাকায় প্রভাব ছিল। তিনি ওই সময়ে বিভিন্ন পদে থাকায় বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা রক্ষা পেয়েছে। দখলের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে।
প্রতিবছর একবার আমরা চাঁদপুরের দাদুর গ্রামের বাড়িতে যাই। উৎসবে অংশ নিই। আমার ঠাকুরমা স্নেহলতা রায় চৌধুরাণী সোনারগাঁয়ের পানাম নগরীর জমিদার বংশের মেয়ে ছিলেন। দাদুর মৃত্যুর আটবছর পর ঠাকুরমাও মারা যান।
রমেশ চন্দ্র রায় চৌধুরীর প্রতিষ্ঠিত মেসার্স রমেশ রায় চৌধুরী মুদি দোকানই আমাদেরই কর্মক্ষেত্র। এগিয়ে চলা। দাদুর জায়গায় এখন মৈত্রী ভবন। সেখানে আমাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। উনার পরিচয়েই বেঁচে আছি।
দাদুর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে তাঁর প্রতিষ্ঠিত মন্দিরে আজ রাত আটটার পরে প্রার্থনা ও রাত প্রসাদ বিতরণ করা হবে।
রমেশ চন্দ্র রায় চৌধুরী ছিলেন ক্ষণজন্মা পুরুষ। চলনে বলনে তিনি ছিলেন অসাধারণ। মানবের কল্যাণে কাজ করেছেন আমৃত্যু। সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে পরিশ্রম করে তিনি এগিয়ে যান। কুমিল্লা নগরের মানুষ এখনও তাঁকে স্মরণ করে। আমাদের পথচলায় তিনি অহর্নিশ আছেন। প্রতিদিন কোন না কোনভাবে তাঁকে স্মরণ করি। তাঁর বিশাল কর্মকে উপলব্ধি করি। তাঁর দৃষ্টান্ত হতে চাই। কৈশোরে দাদুকে হারাই। কিন্তু তাঁর অপত্য স্নেহ এখনও মনে পড়ে। কত দুষ্টুমি, খুঁনসুটি ও আনন্দযজ্ঞে মেতেছিলাম দাদু আর আমি। অতল শ্রদ্ধা দাদু।
সজীব রায় চৌধুরী: ব্যবসায়ী ও রমেশ চন্দ্র রায় চৌধুরীর নাতি।