বাগানঘেরা বাড়িতে লিটুর ‘আমিষের’ ফার্ম জেড এইচ এগ্রো পার্ক

গরু, দুধ, ভেড়া, মাছ ও ডিমের কারবার

গাজীউল হক সোহাগ, ধনুয়াখলা থেকে ফিরে
Thumbnail image

কুমিল্লার লালমাই ও ময়নামতি পাহাড়ের মধ্যবর্তী স্থানের উঁচু নিঁচু টিলার ফাঁকের আঁকা বাঁকা পথ পেরিয়ে কালীরবাজার। বাজার থেকে অদূরেই সবুজে ঘেরা ধনুয়াখলা গ্রাম। গ্রামটি দেশের আর দশটি গ্রামের ছেয়ে একটু আলাদা। এই গ্রামের প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আসে। গ্রামের পরিবেশও সুন্দর। দালানকোটা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একাকার। এই গ্রামের ব্যতিক্রমী এক তরুণের নাম মোহাম্মদ জিয়াউল হক। বন্ধুরা ডাকেন লিটু নামে। গ্রামের লোকজনের কাছে লিটন নামে পরিচিত। লিটুই প্রতিষ্ঠা করেছেন জেড এইচ এগ্রো পার্ক। দুই দশকের বেশি সময় ধরে এই ফার্ম কুমিল্লা শহর ও শহরতলির মানুষের আমিষের চাহিদা মেটাতে অগ্রণী ভূমিকা রাখছে। শিক্ষিত, পরিশ্রমী ও স্বপ্নবান এই তরুণের ফার্মের সুনামও আছে কুমিল্লা জুড়ে।

শরতের শেষ বিকেলে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষককে সঙ্গে নিয়ে ওই ফার্মে প্রবেশ করি। জেড এইচ এগ্রো পার্কের ফটকে পা রেখেই মুগ্ধতার আবেশে জড়িয়ে গেল প্রাণ। বাগানঘেরা বাড়ি। গাছগাছালিতে ভরা। ফাঁকে ফাঁকে পুকুর। একটি নয়, দুইটি নয়- ১৩ টি পুকুর। পুকুরে নানা প্রজাতির মাছ। পাঙাস মাছের দল খাবারের ছোটাছুটি করছে। পুকুরের পাড়ে গরুর খামারের শেড। কোনটি দুগ্ধজাত গাভী। কোনটি ষাঁড়। অন্তত ৮০ টি গরু দেখা গেছে। আছে বাছুরও। আমাদের উপস্থিতির সময়ে কয়েকটি গরু ফরিদ গ্রুপের পরিচালক দেলোয়ার হোসেন মানিকের ফার্মে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। তখন অন্য গরুগুলো চিৎকার করছে।

কর্মীরা জানালেন, যখন কোন গরু এখান থেকে বের করা হয়, তখন অন্য গরুগুলো চিৎকার করে। কান্না করে।

গরুর শেড পেরিয়ে দেখি এলাহী কারবার। দুইটি শেডে হাজার হাজার লেয়ার ( ডিমপাড়া মুরগি)। ডিম পাড়া মুরগি। ডিম পারছে। এর মধ্যে জেড এইচ এগ্রো পার্কের স্বত্বাধিকারী লিটু জানালেন, এক ডিমে দুইটি করে কুসুমও হয়। দুইটি ডিম এনে দেখালেন তিনি।

এক পর্যায়ে দেখা গেল, পুকুরপাড়ে হাঁটছে ভেড়ার দল। পুকুরের পাড়ে কাঁঠাল, কলা, আম, জাম গাছ। আছে কৃষি ফার্মও । লালশাক বপন করা আছে। প্রাণিদের কোলাহল আছে। খামারের পাশে ঘাসের জমি। ওই জমিতে প্রতিদিন ঘাস কাটেন লিটু। তিনি বলেন,‘ নিজে হাত না লাগালে ব্যবসা বড় হয় না। শরীরও ঠিক থাকে না।’

ফার্ম করার গল্পটা শুনুন মোহাম্মদ জিয়াউল হক লিটুর কাছে।‘ ... ছোটবেলা থেকেই আমাদের বাগিচাগাঁও এলাকার বাসায় মুরগি পালা হতো। এগুলো আমি দেখতাম। পশুপাখির প্রতিও আমার দরদ ছিল। ২০০১ সালে কয়েকজন বন্ধু মিলে ফার্ম করি। এতে মন ভরেনি। পরবর্তীতে ২০০৪ সালে ধনুয়াখলা গ্রামের নিজেদের তিন একর জায়গায় পাঁচ হাজার মুরগির শেড চালু করি। এর পাশাপাশি কিছু গরু পালন করি। তখন প্রতিষ্ঠানের নাম দিই ‘জেড এইচ এগ্রো পার্ক’। কয়েক বছর পর আরও সাত একর জমি নিই। তখন ফার্মের পরিসর বাড়ানো হয়। তখন তিনটা শেড করা হয়। ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে শেড। এখন ফার্মে চারটি শেডে ২২ হাজার মুরগি রাখার ব্যবস্থা আছে। গরু ও বাছুর আছে ১২০ টির মতো। ভেড়া আছে ৬০ টি। পুকুর ভরা মাছ আছে। এদের দেখভাল করার জন্য ৩০ জন কর্মী আছে। প্রতিদিন কুমিল্লা শহরের বাগিচাগাঁও এলাকা থেকে সকালে আসি ফার্মে, রাতে বাসায় ফিরি। আমার বাবা মোহাম্মদ সামসুল হক ও মা জমিলা হক ফার্ম এলাকায় থাকেন। তাঁরাও মনিটরিং করেন।’

ধনুয়াখলা গ্রামের এক সময়ের প্রবাসী মোহাম্মদ সামসুল হক ও জমিলা হকের এক মেয়ে ও এক ছেলে। মেয়ে সেলিনা হক আমেরিকায় থাকেন। একমাত্র ছেলে লিটু। বিবিএ পাস করার পর ব্যবসায় নামেন। তাঁর ফার্মের সুনাম আছে। কুমিল্লা শহরের বিভিন্ন পরিবারে তাঁর ফার্মের দুধ ও ডিম যায়। বাসায় বিপননে সহযোগিতা করেন লিটুর সহধর্মিনী সামিয়া আফরিন। কোরবানির ঈদে তাঁর ফার্ম থেকে গরু কিনে এনে কোরবানি দেওয়া হয়।

সদ্য বিদায়ী কুমিল্লা জেলা প্রাণীসম্পদ কর্মকর্তা চন্দন কুমার পোদ্দার বলেন, জেড এইচ এগ্রো পার্ক পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। পরিকল্পনা করে তিনি ফার্ম করেছেন। লিটু সাহেবের স্বপ্ন, পরিশ্রম ও পড়াশোনার মিশেলে এই ফার্ম। প্রকৃতির কোল জুড়ে এই ফার্ম।

বিষয়:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

সম্পর্কিত