‘জুলাই এসেছে, কিন্তু আমার স্বামী তো আসল না!’

লাকসাম প্রতিনিধি
Thumbnail image

‘বছর ঘুরে জুলাই তো ঠিকই আসছে, কিন্তু আমার স্বামী তো আসল না! আমার মেয়েটার বয়স এখন আট বছর চলছে। সে এখনো জানে না তার বাবা কোথায়। স্কুলে ভর্তি করিয়েছি। যখন দেখে অন্যদের বাবা স্কুল থেকে নিয়ে যায়, তখন বাড়িতে ফিরে কান্নাকাটি করে আর বলে— ‘মা, আমার বাবা কোথায়? বাবা আমাকে কেন নিতে আসে না? ‘আমি মিথ্যে বলি, তোমার বাবা বেড়াতে গেছে। কিন্তু আর কতদিন এই মিথ্যা সান্ত্বনা দেব?’

স্বামী হারানো এক বছরের শোকের ভার বয়ে বেড়ানো এ নারী রেহানা আক্তার রানু এ কথাগুলো বলেছেন।

গত ২০ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে নিহত হন কুমিল্লা লাকসাম উপজেলার সাতঘর ইছাপুরা গ্রামের প্রয়াত শহিদ মিয়ার ছেলে ইউছুফ মিয়া (৪০)। স্বামীকে হারিয়ে শোক আর অভাবের তাড়নায় দিশেহারা শহীদ ইউছুফ মিয়ার স্ত্রী রেহানা আক্তার রানুর। তাঁর স্বামীর স্মৃতি মনে পড়লেই করেন আহাজারি।

ইউছুফ মিয়ার বাড়িতে গেলে দেখা যায়, ইউছুফের স্ত্রী রানু ও তাদের আট বছরের মেয়ে সন্তান রাইজা এবং অসুস্থ বৃদ্ধ মা মরিয়ম বিবিসহ একটি ভাঙা টিনের ছাউনিযুক্ত ঘরের সামনে বসে আছেন। ইউছুফের মৃত্যুর কথা জিজ্ঞেস করতেই হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন স্ত্রী রানু ও তার বৃদ্ধ মা মরিয়ম বিবি!

ইউছুফের মা বলেন, ‘আমার পাঁচ ছেলে দুই মেয়ে রেখে স্বামী কয়েকবছর পূর্বে মারা যান তিনি। আমার এ সন্তানদের মধ্যে ইউছুফ মিয়া ছিলেন সবার বড়, ইউছুফ ছিল পরিবারের একমাত্র ভরসা। তার রোজগারেই চলত সংসার। সামাজিকভাবে ১০ বছর আগে একই ইউনিয়নের রেহানা আক্তার রানুকে বিয়ে করেন আমার সন্তান ইউছুফ। তার স্ত্রীসহ আট বছরের বয়সী ইশরাত জাহান রাইজা নামে একটি মেয়ে সন্তান রয়েছে। উপার্জনক্ষম একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে আমরা এখন নি:স্ব। ছেলের ছবি দেখে দেখে চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। সামনের দিনগুলো কিভাবে কাটবে এই চিন্তায় এখন অস্থির। আমার ছেলের কী দোষ ছিল? কেন তাকে গুলি করে হত্যা করা হলো?’

যে ঘরে বসে আছেন, এ ঘরে কে থাকেন- জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ ঘরটি ইউছুফ মিয়ার ঘর, আমার বৌ মা, নাতনি ও আমি থাকি। মাঝেমধ্যে ইউছুফ মিয়ার স্ত্রী তার সন্তানকে নিয়ে তার বাপের বাড়িতে বেড়াতে যায় আবার চলে আসে।

রেহানা আক্তার রানু বলেন, ‘আমার জীবনের প্রদীপ নিভে গেছে গত ২০ জুলাই আন্দোলনে। সেই আন্দোলনে যা হারিয়েছি, কোনো কিছুর বিনিময়েই সেই অভাব পূরণ হওয়ার নয়। ‘আমার মেয়েটা বাবাকে হারিয়ে এতিম হলো। এখন সে ‘বাবা বাবা’ বলে ডাকে। আমি তাকে বাবার মুখ কোথায় দেখাব? কীভাবে এই শোক ভুলব?’

তিনি আরও বলেন, সরকার যতই অনুদান দিক, যতই সাহায্য-সহযোগিতা করুক, আমার একমাত্র সন্তানকে যতই প্রতিষ্ঠিত করে দিক, তার বাবার অভাব কেউ ফিরিয়ে দিতে পারবে না। আমি এখন অন্ধকারে পড়ে গেলাম, ‘একটি কন্যাসন্তান রেখে স্বামী এভাবে চলে গেল? আমি এখন অসহায় হয়ে পড়লাম।’ আমি না পেলাম স্বামীকে, না পেলাম স্বামীর হত্যার বিচার!’

জানা যায়, গত ২০ জুলাই ইউসুফ মিয়ার ছোট ভাই মোহাম্মদ খোকন অসুস্থ ছিল। তাকে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে চিকিৎসা করানো হয়। চিকিৎসাশেষে খোকনের সঙ্গে শনির আখড়ায় বাসায় যাচ্ছিল দুই ভাই। ওই দিন দুপুরে পথে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ চলছিল আন্দোলনকারীদের। তারা রাস্তা পারাপার হয়ে শনিআখড়া ব্রিজ এলাকার দিকে যাওয়ার সময় ইউসুফের বুকে গুলিবিদ্ধ হন। পরে স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন।

ইউসুফ পেশায় ছিলেন ঢাকা শহরের টিবিসির পণ্যসামগ্রী বিক্রির গাড়ির ড্রাইভার। গত বছর ২২ জুলাই ঢাকা থেকে ইউসুফ মিয়ার লাশ আনা হয় নিজ গ্রামে। পরে তাকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।

বিষয়:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

সম্পর্কিত