ভাস্কর মজুমদার
শুরুটা হয়েছিল অনেক আগে থেকেই—পরিকল্পনার আঁচে আগুন ধরেছিল বন্ধুত্বের টানে। কুমিল্লা থেকে ৯৭/৯৯ ব্যাচের বহু পুরনো বন্ধু এবারও এক হলাম সেই চিরচেনা উদ্দেশ্যে—প্রতি বছরের মতো একসাথে ভ্রমণে বেরিয়ে পড়া। এবার গন্তব্য ছিল বাংলাদেশের প্রাণুসমুদ্রের শহর কক্সবাজার। তারিখ চূড়ান্ত হলো—২০ জুন শুক্রবার রওনা, ফিরে আসার কথা ২২ জুন, রবিবার। তাই আগেভাগেই অনুরোধ করা হলো—যেন রোজগেরে বন্ধুরা ছুটির ব্যবস্থা করে রাখে।
১৯ জুন, বৃহস্পতিবার গভীর রাতে কুমিল্লা টাউন হল থেকে শুরু হয় আমাদের ভ্রমণের মূল অভিযান—স্লিপিং কোচে চড়ে আমরা ছুটে চলি সাগরের ডাকের দিকে। তবে আমরা তিনজন নানা ব্যস্ততায় কুমিল্লা থেকে এক বাসে উঠতে পারিনি। বিকল্প হিসেবে ঢাকা থেকে বিমানে রওনা দিয়ে সোজা গিয়ে হাজির হলাম নির্দিষ্ট দিনে, নির্দিষ্ট সময়ে—কক্সবাজারের তারকাখচিত হোটেল সায়মন-এ।
হোটেল সায়মনের প্যানোরামা সী ভিউ রুমগুলো আগেভাগেই আমাদের জন্য বুক করা ছিল। রুমে ঢুকেই জানালার ওপারে নীল জলরাশি দেখে যেন কৈশোরের দিনগুলো ফিরে এলো। তরঙ্গের ডাক আর বালুকার আঁচড়ে মন ভেসে গেল আমাদের সেই স্কুল-কলেজ জীবনের দিনগুলিতে। দুপুরে লাঞ্চ সেরে নিলাম হোটেলের পাশের এক চমৎকার বাংলা রেস্টুরেন্টে।
আর তার পর?
ডিনারের সময় পর্যন্ত যে যার মতো করে সময় কাটালাম—
কেউ পাড়ে বসে পা ডুবিয়ে তাকিয়ে ছিল সাগরের দিকে, কেউ বা গিটার হাতে তুলে গেয়ে উঠেছিল ফেলে আসা দিনের সেই চেনা গান,
কেউ ব্যালকনিতে ঝিম মেরে খালি চোখে তাকিয়ে ছিল দূরের নীল দিগন্তে,
আর কেউ বালিশ জড়িয়ে হালকা ঘুম দিয়েছিল দুপুরের নিরবতায়।
আড্ডা, গল্প, হেসে কুটিকুটি—সবকিছু মিলিয়ে যেন এক শান্ত আনন্দের স্রোত বয়ে চলেছিল।
রাতের ডিনার ছিল যেন এক স্বপ্নের মতো—সমুদ্রের ধারে, মারমেইড ক্যাফে-তে, সী-ফুড বারবিকিউর এক লোভনীয় অভিজ্ঞতা। চারপাশে ছিল বৃষ্টির ছোঁয়া, ঢেউয়ের শব্দ, আর আমাদের প্রাণখোলা হাসি।
সেই রাতে কক্সবাজারে ছিল প্রবল বর্ষণ, অতিথিও ছিল কম। ফলে আমাদের আনন্দের বাঁধ ভেঙে গেল—কখন সেটা দলীয় সংগীত-অনুষ্ঠানে পরিণত হলো, তা বুঝতেই পারিনি! হোটেলের কাচঘেরা ওপেন কিচেনের স্টাফরাও আমাদের উচ্ছ্বাসে অংশ নিয়েছিল। নাচ, গান, হইহুল্লোড়—সবকিছু মিলিয়ে মনে হচ্ছিল আমরা যেন ফিরে গেছি সেই প্রাণবন্ত স্কুল-কলেজ জীবনের দিনগুলোতে।
পরদিন সকালে নাস্তা শেষে একচোট জলকেলি সেরে আমরা চড়ে বসলাম এক বিশেষ যানে—দোতলা ছাদখোলা রুফটপ ক্যারাভান রাইডে। মেরিন ড্রাইভ দিয়ে সাগরের পাশ ঘেঁষে সেই যাত্রা ছিল আমাদের সবার জন্য এক বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা। বাহনটা যেন এক চলন্ত মঞ্চ, যেখানে বন্ধুদের গানে গানে, আড্ডায় আড্ডায় সময় থমকে দাঁড়িয়েছিল।
পথে পথে থেমে থেমে চললো ছবি তোলা, হাসি-ঠাট্টা। একসময় সাগর পাড়ে নেমে সবাই মিলে খেলতে শুরু করলাম ফুটবল। কিন্তু দশ মিনিট না যেতেই বুঝে গেলাম—এই খেলায় শরীরের যা অবস্থা হচ্ছে, তাতে ঘরে ফিরেই ডাক্তারের কাছে ছোটার অবস্থা হবে! তাই আবার চড়ে বসলাম ক্যারাভানে।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে আমরা থামলাম ইনানী বিচের আগে বেওয়াচ রিসোর্টে। সেখানে চলছিল লাইভ মিউজিক—আর সেই সুরের টানে, সী-ফুডের ঘ্রাণে, একে একে সবাই যেন হারিয়ে গেলাম সুরের ভুবনে। সেখান থেকে আরও এক ঘণ্টার জার্নি করে আমরা হোটেলে ফিরি।
ফিরে এসে একটু বিশ্রাম নিয়ে রাতের খাবার খেলাম শালিক হোটেল-এ—সবার সাথে বসে একসাথে ভাগ করে নেওয়া সুখ-দুঃখ, স্মৃতি আর মুহূর্তের গল্প।
শেষ দিন সকালে সবাই একটু দেরি করেই ঘুম থেকে উঠি। নাস্তার পরপরই শুরু হয় ফেরার প্রস্তুতি। মন ভারী হয়ে আসে, তবুও জানি—এ এক ‘বিদায় নয়, বিরতি’।
এই ভ্রমণের প্রতিটি মুহূর্ত আজও চোখ বুজলেই সামনে ভেসে ওঠে—সাগরের ঢেউয়ের মতোই টালমাটাল, উদ্দাম, অথচ শান্তিময়।
আর এই ভ্রমণ সফল ও প্রাণবন্ত করে তোলার নেপথ্য নায়করা হলেন—অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী বন্ধু ইমরান মালিক মান্না, সবার প্রিয় আলোচিত মুখ নিজাম উদ্দিন কায়সার এবং সফল ব্যবস্থাপনার কারিগর মইন উদ্দিন সরকার।
এ ভ্রমণ কেবল কক্সবাজার দর্শন নয়—এ যেন বন্ধুত্বের সুরে বাঁধা এক স্মৃতির গান, যার নামই হতে পারে—
সুর, সমুদ্র আর আমাদের সময়
লেখক : ভাস্কর মজুমদার, পুরাতন চৌধুরী পাড়া, কুমিল্লা।
মহা ব্যাবস্থাপক- ব্র্যাক আড়ং ও সাবেক শিক্ষার্থী (পরিসংখ্যান বিভাগ), চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
শুরুটা হয়েছিল অনেক আগে থেকেই—পরিকল্পনার আঁচে আগুন ধরেছিল বন্ধুত্বের টানে। কুমিল্লা থেকে ৯৭/৯৯ ব্যাচের বহু পুরনো বন্ধু এবারও এক হলাম সেই চিরচেনা উদ্দেশ্যে—প্রতি বছরের মতো একসাথে ভ্রমণে বেরিয়ে পড়া। এবার গন্তব্য ছিল বাংলাদেশের প্রাণুসমুদ্রের শহর কক্সবাজার। তারিখ চূড়ান্ত হলো—২০ জুন শুক্রবার রওনা, ফিরে আসার কথা ২২ জুন, রবিবার। তাই আগেভাগেই অনুরোধ করা হলো—যেন রোজগেরে বন্ধুরা ছুটির ব্যবস্থা করে রাখে।
১৯ জুন, বৃহস্পতিবার গভীর রাতে কুমিল্লা টাউন হল থেকে শুরু হয় আমাদের ভ্রমণের মূল অভিযান—স্লিপিং কোচে চড়ে আমরা ছুটে চলি সাগরের ডাকের দিকে। তবে আমরা তিনজন নানা ব্যস্ততায় কুমিল্লা থেকে এক বাসে উঠতে পারিনি। বিকল্প হিসেবে ঢাকা থেকে বিমানে রওনা দিয়ে সোজা গিয়ে হাজির হলাম নির্দিষ্ট দিনে, নির্দিষ্ট সময়ে—কক্সবাজারের তারকাখচিত হোটেল সায়মন-এ।
হোটেল সায়মনের প্যানোরামা সী ভিউ রুমগুলো আগেভাগেই আমাদের জন্য বুক করা ছিল। রুমে ঢুকেই জানালার ওপারে নীল জলরাশি দেখে যেন কৈশোরের দিনগুলো ফিরে এলো। তরঙ্গের ডাক আর বালুকার আঁচড়ে মন ভেসে গেল আমাদের সেই স্কুল-কলেজ জীবনের দিনগুলিতে। দুপুরে লাঞ্চ সেরে নিলাম হোটেলের পাশের এক চমৎকার বাংলা রেস্টুরেন্টে।
আর তার পর?
ডিনারের সময় পর্যন্ত যে যার মতো করে সময় কাটালাম—
কেউ পাড়ে বসে পা ডুবিয়ে তাকিয়ে ছিল সাগরের দিকে, কেউ বা গিটার হাতে তুলে গেয়ে উঠেছিল ফেলে আসা দিনের সেই চেনা গান,
কেউ ব্যালকনিতে ঝিম মেরে খালি চোখে তাকিয়ে ছিল দূরের নীল দিগন্তে,
আর কেউ বালিশ জড়িয়ে হালকা ঘুম দিয়েছিল দুপুরের নিরবতায়।
আড্ডা, গল্প, হেসে কুটিকুটি—সবকিছু মিলিয়ে যেন এক শান্ত আনন্দের স্রোত বয়ে চলেছিল।
রাতের ডিনার ছিল যেন এক স্বপ্নের মতো—সমুদ্রের ধারে, মারমেইড ক্যাফে-তে, সী-ফুড বারবিকিউর এক লোভনীয় অভিজ্ঞতা। চারপাশে ছিল বৃষ্টির ছোঁয়া, ঢেউয়ের শব্দ, আর আমাদের প্রাণখোলা হাসি।
সেই রাতে কক্সবাজারে ছিল প্রবল বর্ষণ, অতিথিও ছিল কম। ফলে আমাদের আনন্দের বাঁধ ভেঙে গেল—কখন সেটা দলীয় সংগীত-অনুষ্ঠানে পরিণত হলো, তা বুঝতেই পারিনি! হোটেলের কাচঘেরা ওপেন কিচেনের স্টাফরাও আমাদের উচ্ছ্বাসে অংশ নিয়েছিল। নাচ, গান, হইহুল্লোড়—সবকিছু মিলিয়ে মনে হচ্ছিল আমরা যেন ফিরে গেছি সেই প্রাণবন্ত স্কুল-কলেজ জীবনের দিনগুলোতে।
পরদিন সকালে নাস্তা শেষে একচোট জলকেলি সেরে আমরা চড়ে বসলাম এক বিশেষ যানে—দোতলা ছাদখোলা রুফটপ ক্যারাভান রাইডে। মেরিন ড্রাইভ দিয়ে সাগরের পাশ ঘেঁষে সেই যাত্রা ছিল আমাদের সবার জন্য এক বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা। বাহনটা যেন এক চলন্ত মঞ্চ, যেখানে বন্ধুদের গানে গানে, আড্ডায় আড্ডায় সময় থমকে দাঁড়িয়েছিল।
পথে পথে থেমে থেমে চললো ছবি তোলা, হাসি-ঠাট্টা। একসময় সাগর পাড়ে নেমে সবাই মিলে খেলতে শুরু করলাম ফুটবল। কিন্তু দশ মিনিট না যেতেই বুঝে গেলাম—এই খেলায় শরীরের যা অবস্থা হচ্ছে, তাতে ঘরে ফিরেই ডাক্তারের কাছে ছোটার অবস্থা হবে! তাই আবার চড়ে বসলাম ক্যারাভানে।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে আমরা থামলাম ইনানী বিচের আগে বেওয়াচ রিসোর্টে। সেখানে চলছিল লাইভ মিউজিক—আর সেই সুরের টানে, সী-ফুডের ঘ্রাণে, একে একে সবাই যেন হারিয়ে গেলাম সুরের ভুবনে। সেখান থেকে আরও এক ঘণ্টার জার্নি করে আমরা হোটেলে ফিরি।
ফিরে এসে একটু বিশ্রাম নিয়ে রাতের খাবার খেলাম শালিক হোটেল-এ—সবার সাথে বসে একসাথে ভাগ করে নেওয়া সুখ-দুঃখ, স্মৃতি আর মুহূর্তের গল্প।
শেষ দিন সকালে সবাই একটু দেরি করেই ঘুম থেকে উঠি। নাস্তার পরপরই শুরু হয় ফেরার প্রস্তুতি। মন ভারী হয়ে আসে, তবুও জানি—এ এক ‘বিদায় নয়, বিরতি’।
এই ভ্রমণের প্রতিটি মুহূর্ত আজও চোখ বুজলেই সামনে ভেসে ওঠে—সাগরের ঢেউয়ের মতোই টালমাটাল, উদ্দাম, অথচ শান্তিময়।
আর এই ভ্রমণ সফল ও প্রাণবন্ত করে তোলার নেপথ্য নায়করা হলেন—অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী বন্ধু ইমরান মালিক মান্না, সবার প্রিয় আলোচিত মুখ নিজাম উদ্দিন কায়সার এবং সফল ব্যবস্থাপনার কারিগর মইন উদ্দিন সরকার।
এ ভ্রমণ কেবল কক্সবাজার দর্শন নয়—এ যেন বন্ধুত্বের সুরে বাঁধা এক স্মৃতির গান, যার নামই হতে পারে—
সুর, সমুদ্র আর আমাদের সময়
লেখক : ভাস্কর মজুমদার, পুরাতন চৌধুরী পাড়া, কুমিল্লা।
মহা ব্যাবস্থাপক- ব্র্যাক আড়ং ও সাবেক শিক্ষার্থী (পরিসংখ্যান বিভাগ), চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়