চন্দন দাস

বাণিজ্য, সমাজসেবা এবং মানবিকতার এক উজ্জ্বল মিশ্রণ—মহেশচন্দ্র ভট্টাচার্য সেই বিরল মানুষদের একজন, যাঁরা নিজের জীবনের প্রতিটি অর্জনকে মানুষের কল্যাণে উৎসর্গ করে গেছেন। দান-ধ্যান, নৈতিকতা, ত্যাগ এবং মানবসেবায় তাঁর যে দৃষ্টান্ত, তা আজও অনুকরণীয়।
ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির তৎকালীন ত্রিপুরার অন্তর্গত (বর্তমানে বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার) বিটঘর গ্রামে ১৮৫৮ সালের ১ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন মহেশচন্দ্র ভট্টাচার্য। তাঁর পিতা ঈশ্বরদাস তর্কসিদ্ধান্ত ছিলেন বিখ্যাত পণ্ডিত এবং মাতা রামমালা দেবী ছিলেন ধর্মপ্রাণ ও সৎগুনসম্পন্ন নারী।
মাত্র ছয় বছর বয়সে পিতাকে হারিয়ে দারিদ্র্যরে মুখোমুখি হলেও, সত্য-নিষ্ঠা ও নীতির শিক্ষা তাঁকে পথ দেখিয়েছিল আজীবন। আর্থিক সংকটে পড়ে প্রথাগত শিক্ষায় অগ্রগতি না হলেও কঠোর পরিশ্রম ও দৃঢ় প্রতিজ্ঞায় তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।
১৮৮৩ সালে নিঃসম্বল অবস্থায় কলকাতায় আগমন। সংগ্রাম আর অধ্যবসায়ের পথ পেরিয়ে ১৮৮৯ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘এম ভট্টাচার্য অ্যান্ড কোম্পানি’, যেখানে স্বল্পমূল্যে হোমিওপ্যাথিক ওষুধ বিক্রির উদ্যোগ তাঁকে বিপুল সাফল্য এনে দেয়। পরে কুমিল্লা ও ঢাকায়ও তিনি শাখা গড়ে তোলেন।
কিন্তু ধনসম্পদের মালিক হয়েও নিজেকে কৃচ্ছ্রসাধনে রাখতেন; ভোগ-বিলাস নয়, মানুষের কল্যাণই ছিল তাঁর জীবনের মূলমন্ত্র।
মহেশচন্দ্র জ্ঞানচর্চা ও শিক্ষাবিস্তারে ছিলেন অগ্রগামী। নিজের আয়ের বড় অংশ ব্যয় করেছেন শিক্ষা, চিকিৎসা ও জনসেবায়—
* রামমালা গ্রন্থাগার (১৯১২) ও রামমালা হোস্টেল (১৯১৪), কুমিল্লা
মায়ের স্মৃতিতে প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠানগুলো আজও কুমিল্লার ঐতিহ্য।
* ঈশ্বর পাঠশালা, কুমিল্লা (১৯১৪)
দরিদ্র ছাত্রদের শিক্ষার সুযোগ করে দিতে পিতার নামে পাঠশালা স্থাপন।
* নিবেদিতা গার্লস স্কুল (১৯১৯)
নারীশিক্ষার প্রসারে তাঁর অসামান্য ভূমিকা।
* জন্মভূমি বিটঘরে শিক্ষা সংসদ প্রতিষ্ঠা
গ্রামীণ শিক্ষায় তাঁর অগ্রদূত ভূমিকা আজও স্মরণীয়।
* কাশীধামে (বারাণসী) ঈশ্বর পাঠশালা টোল
সংস্কৃতশিক্ষা প্রচারে তাঁর অবদান।
পানীয় জলের অভাব দূরীকরণ-
নিজ গ্রামে বহু পুষ্করিণী খনন করিয়ে মানুষের জীবনযাত্রা সহজ করেন। তীর্থভ্রমণে বৈদ্যনাথধামে গিয়ে দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের খাবারের ব্যবস্থা পর্যন্ত করেছিলেন।
সামাজিক সেবা ও দানশীলতা-
* প্রতিদিন ৪০০-৫০০ মানুষকে আহার করানোর ব্যবস্থা করতেন।
* শীতে গরিবদের শীতবস্ত্র বিতরণ করতেন।
* হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা ও বিনামূল্যে ওষুধ বিতরণ তাঁর জীবনের অন্যতম প্রধান কাজ।
* ১৯৩৫ সালে কলকাতায় কালীঘাট হোস্টেল প্রতিষ্ঠা করেন ভ্রমণেচ্ছুক যাত্রীদের জন্য।
* বারাণসীতে স্ত্রী হরসুন্দরীর নামে ধর্মশালা প্রতিষ্ঠা করেন।
মহেন্দ্রলাল সরকার, বটকৃষ্ণ পালদের মতো পুণ্যশ্লোক ব্যক্তিত্বের ধারায় মহেশচন্দ্র ছিলেন সত্যিকারের দানবীর।
রচিত গ্রন্থসমূহ-
হোমিওপ্যাথি জনপ্রিয় করতে তিনি বিভিন্ন ভাষায় বই প্রকাশ করেন। বাংলায় উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ—
* পারিবারিক চিকিৎসা
* স্ত্রীরোগ চিকিৎসা
* হোমিওপ্যাথিক ওলাওঠা চিকিৎসা
* পারিবারিক ভেষজতত্ত্ব
* আত্মকথা (মাই লাইফ)
পরবর্তী স্মারক প্রতিষ্ঠান-
* মহেশ ভট্টাচার্য হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল (হাওড়া, ১৯৬৭)
* বিটঘর দানবীর মহেশ চন্দ্র বিদ্যাপীঠ (নবীনগর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া)
১৯৪৪ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি বারাণসীতে ৮৫ বছর বয়সে তিনি পরলোকগমন করেন। রেখে যান এক অনন্য মানবসেবার ইতিহাস।
আজ তাঁর জন্মদিনে গভীর শ্রদ্ধা—
মহেশচন্দ্র ভট্টাচার্য কেবল এক ব্যবসায়ী নন; তিনি ছিলেন মানবতার দিগন্ত, শিক্ষার আলোকবর্তিকা ও সমাজসেবার এক জীবন্ত প্রতীক।
তাঁর জীবন ও কর্ম আমাদের শিক্ষা দেয়— সত্যিকার সম্পদ হলো দান, মানবতা আর মানুষের পাশে দাঁড়ানোর ক্ষমতা।
চন্দন দাস: সংস্কৃতিকর্মী

বাণিজ্য, সমাজসেবা এবং মানবিকতার এক উজ্জ্বল মিশ্রণ—মহেশচন্দ্র ভট্টাচার্য সেই বিরল মানুষদের একজন, যাঁরা নিজের জীবনের প্রতিটি অর্জনকে মানুষের কল্যাণে উৎসর্গ করে গেছেন। দান-ধ্যান, নৈতিকতা, ত্যাগ এবং মানবসেবায় তাঁর যে দৃষ্টান্ত, তা আজও অনুকরণীয়।
ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির তৎকালীন ত্রিপুরার অন্তর্গত (বর্তমানে বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার) বিটঘর গ্রামে ১৮৫৮ সালের ১ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন মহেশচন্দ্র ভট্টাচার্য। তাঁর পিতা ঈশ্বরদাস তর্কসিদ্ধান্ত ছিলেন বিখ্যাত পণ্ডিত এবং মাতা রামমালা দেবী ছিলেন ধর্মপ্রাণ ও সৎগুনসম্পন্ন নারী।
মাত্র ছয় বছর বয়সে পিতাকে হারিয়ে দারিদ্র্যরে মুখোমুখি হলেও, সত্য-নিষ্ঠা ও নীতির শিক্ষা তাঁকে পথ দেখিয়েছিল আজীবন। আর্থিক সংকটে পড়ে প্রথাগত শিক্ষায় অগ্রগতি না হলেও কঠোর পরিশ্রম ও দৃঢ় প্রতিজ্ঞায় তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।
১৮৮৩ সালে নিঃসম্বল অবস্থায় কলকাতায় আগমন। সংগ্রাম আর অধ্যবসায়ের পথ পেরিয়ে ১৮৮৯ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘এম ভট্টাচার্য অ্যান্ড কোম্পানি’, যেখানে স্বল্পমূল্যে হোমিওপ্যাথিক ওষুধ বিক্রির উদ্যোগ তাঁকে বিপুল সাফল্য এনে দেয়। পরে কুমিল্লা ও ঢাকায়ও তিনি শাখা গড়ে তোলেন।
কিন্তু ধনসম্পদের মালিক হয়েও নিজেকে কৃচ্ছ্রসাধনে রাখতেন; ভোগ-বিলাস নয়, মানুষের কল্যাণই ছিল তাঁর জীবনের মূলমন্ত্র।
মহেশচন্দ্র জ্ঞানচর্চা ও শিক্ষাবিস্তারে ছিলেন অগ্রগামী। নিজের আয়ের বড় অংশ ব্যয় করেছেন শিক্ষা, চিকিৎসা ও জনসেবায়—
* রামমালা গ্রন্থাগার (১৯১২) ও রামমালা হোস্টেল (১৯১৪), কুমিল্লা
মায়ের স্মৃতিতে প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠানগুলো আজও কুমিল্লার ঐতিহ্য।
* ঈশ্বর পাঠশালা, কুমিল্লা (১৯১৪)
দরিদ্র ছাত্রদের শিক্ষার সুযোগ করে দিতে পিতার নামে পাঠশালা স্থাপন।
* নিবেদিতা গার্লস স্কুল (১৯১৯)
নারীশিক্ষার প্রসারে তাঁর অসামান্য ভূমিকা।
* জন্মভূমি বিটঘরে শিক্ষা সংসদ প্রতিষ্ঠা
গ্রামীণ শিক্ষায় তাঁর অগ্রদূত ভূমিকা আজও স্মরণীয়।
* কাশীধামে (বারাণসী) ঈশ্বর পাঠশালা টোল
সংস্কৃতশিক্ষা প্রচারে তাঁর অবদান।
পানীয় জলের অভাব দূরীকরণ-
নিজ গ্রামে বহু পুষ্করিণী খনন করিয়ে মানুষের জীবনযাত্রা সহজ করেন। তীর্থভ্রমণে বৈদ্যনাথধামে গিয়ে দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের খাবারের ব্যবস্থা পর্যন্ত করেছিলেন।
সামাজিক সেবা ও দানশীলতা-
* প্রতিদিন ৪০০-৫০০ মানুষকে আহার করানোর ব্যবস্থা করতেন।
* শীতে গরিবদের শীতবস্ত্র বিতরণ করতেন।
* হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা ও বিনামূল্যে ওষুধ বিতরণ তাঁর জীবনের অন্যতম প্রধান কাজ।
* ১৯৩৫ সালে কলকাতায় কালীঘাট হোস্টেল প্রতিষ্ঠা করেন ভ্রমণেচ্ছুক যাত্রীদের জন্য।
* বারাণসীতে স্ত্রী হরসুন্দরীর নামে ধর্মশালা প্রতিষ্ঠা করেন।
মহেন্দ্রলাল সরকার, বটকৃষ্ণ পালদের মতো পুণ্যশ্লোক ব্যক্তিত্বের ধারায় মহেশচন্দ্র ছিলেন সত্যিকারের দানবীর।
রচিত গ্রন্থসমূহ-
হোমিওপ্যাথি জনপ্রিয় করতে তিনি বিভিন্ন ভাষায় বই প্রকাশ করেন। বাংলায় উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ—
* পারিবারিক চিকিৎসা
* স্ত্রীরোগ চিকিৎসা
* হোমিওপ্যাথিক ওলাওঠা চিকিৎসা
* পারিবারিক ভেষজতত্ত্ব
* আত্মকথা (মাই লাইফ)
পরবর্তী স্মারক প্রতিষ্ঠান-
* মহেশ ভট্টাচার্য হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল (হাওড়া, ১৯৬৭)
* বিটঘর দানবীর মহেশ চন্দ্র বিদ্যাপীঠ (নবীনগর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া)
১৯৪৪ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি বারাণসীতে ৮৫ বছর বয়সে তিনি পরলোকগমন করেন। রেখে যান এক অনন্য মানবসেবার ইতিহাস।
আজ তাঁর জন্মদিনে গভীর শ্রদ্ধা—
মহেশচন্দ্র ভট্টাচার্য কেবল এক ব্যবসায়ী নন; তিনি ছিলেন মানবতার দিগন্ত, শিক্ষার আলোকবর্তিকা ও সমাজসেবার এক জীবন্ত প্রতীক।
তাঁর জীবন ও কর্ম আমাদের শিক্ষা দেয়— সত্যিকার সম্পদ হলো দান, মানবতা আর মানুষের পাশে দাঁড়ানোর ক্ষমতা।
চন্দন দাস: সংস্কৃতিকর্মী