শিষ্টাচারের মৃত্যু – আমাদের নীরবতার দায়

ভাস্কর মজুমদার
আপডেট : ০৯ আগস্ট ২০২৫, ১২: ১১
Thumbnail image

এক সময় ছিল—রাজনীতি মানেই ছিল আদর্শের লড়াই, মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা, আর শব্দের মধ্যে শালীনতার শান। ছাত্ররাজনীতি মানে ছিল জ্ঞানের আলো, ত্যাগের গল্প, মানুষের স্বপ্ন বুনে দেওয়ার মতো কথা। আমরা যারা সেই সময় কাটিয়েছি, জানি ছাত্রনেতাদের ভাষণ শোনার অনুভূতি কেমন ছিল—সেটা ছিল এক অনন্য অভিজ্ঞতা, যা আজ কল্পনাও করা যায় না।

তখন মঞ্চে দাঁড়িয়ে নেতারা কথা বলতেন দৃপ্ত কণ্ঠে, চোখে জ্বলজ্বল করত স্বপ্নের আলো। তাদের বক্তৃতায় ছিল রবীন্দ্রনাথের শান্ত-গভীর বাণী, নজরুলের বিদ্রোহী সুর, জীবনানন্দের মাটির গন্ধ মেশানো দেশপ্রেম। কোনো চটুল অশ্লীলতা ছিল না, কোনো নিম্নমানের শব্দ ছিল না—ছিল শুধু প্রেরণা, সাহস আর ন্যায়ের আহ্বান।

সেই আহ্বান শুনে গায়ে কাঁটা দিত, বুকের ভেতর রক্ত ফুসে উঠত। মনে হতো, এই দেশ, এই মানুষ, এই মাটির জন্য জীবন দিয়েও লড়াই করা যায়।

কিন্তু আজ?

আজকের মঞ্চ যেন সেই স্বপ্নের বিপরীত ছবি—যেখানে শিষ্টাচার মরে গেছে, অশ্লীলতা রাজত্ব করছে, আর গালাগালি যেন রাজনৈতিক ভাষার নতুন অভিধান হয়ে উঠেছে। দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রনেতারা, যারা আগামী দিনের নেতৃত্ব গড়বে, তারাই অবলীলায় যৌন উসকানিমূলক, বাজারি ও লজ্জাজনক শব্দ উচ্চারণ করছে—হাজারো মানুষের সামনে, গর্বের সঙ্গে! নিষিদ্ধ পল্লীতেও হয়তো এতটা নোংরা ভাষা উচ্চারণ হয় না।

লজ্জায় সন্তানদের সামনে এসব শোনা যায় না।

ফেসবুকে রাজনৈতিক বক্তৃতার ভিডিও এলে ভলিউম বন্ধ করে দিতে হয়। কারণ, আমরা যারা একসময় শুনতাম—

"পদ্মা, মেঘনা, যমুনা – তোমার আমার ঠিকানা"

"বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর"

তাদের জায়গায় এখন ভেসে আসে—

"এক, দুই, তিন, চার – একে ওকে পু** মার"

শিউরে উঠি।

ভাবি—যে প্রজন্ম রাজনীতির প্রথম পাঠ হিসেবে এই ভাষা শিখছে, তারা বড় হয়ে কেমন নেতা হবে? তাদের হাতে গেলে দেশের ভবিষ্যৎ কেমন হবে?

আরও ভয় হয় এই ভেবে যে, এর দায় থেকে আমরা নিজেরাও মুক্ত নই। কারণ আমরা চুপ থেকেছি। আমরা নীরব দর্শক হয়ে গেছি। আমরা প্রতিবাদ করিনি। আমরা ভেবেছি—“এটা আমার বিষয় নয়।” আর তথাকথিত সুশীল সমাজ? তারা যেন মুখে তালা মেরে বসে আছে। চারপাশে শুধু ফিসফাস—কিন্তু প্রকাশ্যে কেউ বলে না, “এটা ভুল।”

রাজনৈতিক শিষ্টাচার মানে কেবল ভদ্র ভাষা নয়—এটা এক ধরণের সংস্কৃতি, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সঞ্চারিত হয়। যখন সেটা ভেঙে যায়, তখন শুধু রাজনীতি নয়—পুরো সমাজটাই ধ্বংসের পথে চলে যায়। আমরা যদি আজকের এই অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে না পারি, তাহলে আগামী দিনের ইতিহাসে আমাদের নাম লেখা থাকবে—নীরব বিশ্বাসঘাতক হিসেবে, যারা চোখের সামনে শিষ্টাচারের মৃত্যু দেখেও কিছু বলেনি।

রাজনীতির এই নোংরা ভাষা হয়তো একদিন বদলাবে, কিন্তু তার জন্য প্রজন্মের পর প্রজন্ম ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আর তখন হয়তো নতুন প্রজন্ম আমাদের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করবে—এই আজকের নীরবতার জন্য।

ভাস্কর মজুমদার : মহাব্যবস্থাপক, ব্র্যাক আড়ং।

বিষয়:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

সম্পর্কিত