ভাস্কর মজুমদার
কখনো ভোররাতে, কখনো নিঃসঙ্গ দুপুরে—একটি ঘরের জানালা দিয়ে ঢুকে পড়ে ভয়। কখনো শ্বাসরোধ করে, কখনো মুখ চাপা দেয়, কখনো আবার তার চেয়েও ভয়ংকর কিছু করে—স্মৃতি থেকে সম্মান পর্যন্ত ছিনিয়ে নেয়। বাংলাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতা আজ যেন হাওয়া, বাতাসের মতোই সর্বত্র ছড়িয়ে আছে—দেখা যায় না, কিন্তু প্রতিটি মেয়ের শ্বাসে তার ভার টের পাওয়া যায়।
কুমিল্লার মুরাদনগরের পাঁচকিত্তা গ্রামে ঘটে যাওয়া সাম্প্রতিক একটি ঘটনা আমাদের সমাজের বিবেককে এমন এক আয়নায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, যেখানে আমরা নিজের মুখ দেখতে ভয় পাই। একজন নারী, যিনি প্রবাসী স্বামীর অনুপস্থিতিতে সন্তানসহ বাবার বাড়িতে অবস্থান করছিলেন—রাতের আঁধারে নিজ ঘরে এক প্রতিবেশীর হাতে ধর্ষণের শিকার হন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তার নিপীড়নের যাত্রা সেখানেই থেমে থাকেনি।
ঘটনার পরপরই কিছু মানুষ সেই নারীর সামনে দাঁড়িয়ে তদন্তকারীর ভান করে, নানা প্রশ্নবানে তাকে জর্জরিত করে, তাকে আক্রমণ করে এবং তার কান্না ও অসহায়ত্বকে ভিডিও করে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়। এই ভিডিওগুলো ভাইরাল হয়—মতামত, মজা, কৌতূহল আর ভীষণ অসংবেদনশীল মন্তব্যের জোয়ারে। কেউ কেউ চোখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলে—ুএটা নতুন কিছু না।” এই প্রতিক্রিয়া আমাদের মানবিকতার সবচেয়ে করুণ মুখ।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের ২০২৩ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, শুধু এক বছরেই ধর্ষণের ঘটনা ছিল ৪,৬২২টি। জাতিসংঘের এক জরিপ বলছে—প্রতি দুই নারীর একজন জীবনের কোনো না কোনো সময়ে শারীরিক বা যৌন সহিংসতার শিকার হন। কিন্তু এসব সংখ্যার আড়ালে ঢাকা পড়ে যায় একজন নারীর ভেতরের ভাঙন, তার সন্তানের চোখে সমাজের বিষাক্ত চেহারা।
মুরাদনগরের ঘটনাটি আমাদের দেখিয়ে দেয়—এই সমাজে ধর্ষণ কেবল শারীরিক সহিংসতা নয়, তা হয়ে উঠেছে সামাজিক অপমান ও প্রযুক্তির অপব্যবহারে দ্বিতীয়বার নিপীড়নের হাতিয়ার। কেউ তার পাশে দাঁড়ায় না, বরং প্রশ্ন তোলে তার চারিত্রিক গঠন নিয়ে। আমরা তাকে সান্ত্বনা দিই না, বরং আরও ভেঙে দিই।
ঘটনার পর অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং মামলা হয়েছে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে। কিন্তু প্রশ্ন থাকে—এই নারীর সম্মান কি ফিরবে? তার সন্তান কি আর কখনো নির্ভয়ে সমাজের দিকে তাকাতে পারবে?
এই পরিস্থিতি বদলাতে হলে দরকার কেবল আইনি পদক্ষেপ নয়, প্রয়োজন মানবিকতা-ভিত্তিক সামাজিক পরিবর্তন। আমাদের পারিবারিক শিক্ষা, মিডিয়া চর্চা, প্রযুক্তি ব্যবহার, এবং প্রতিদিনের কথোপকথনেও এমন দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে হবে—যেখানে নারীকে কেবল ভুক্তভোগী বা পণ্য নয়, একজন পূর্ণমানুষ হিসেবে দেখা হবে।
আমাদের সমাজের প্রতিটি স্তরে—পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্র ও অনলাইন প্ল্যাটফর্ম—সবখানেই নতুন করে ভাবতে হবে: আমরা কেমন সমাজ চাই? একটিবার ভাবুন, যদি ভুক্তভোগী নারী আপনার মা, বোন বা মেয়ে হতেন, তাহলে কী করতেন?
আর সবচেয়ে জরুরি হলো—আমরা যেন নারীর কণ্ঠস্বর শুনতে শিখি। যেন তাঁর কথাগুলো বিচারকের চেয়ারে বসে নয়, অথবা অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে নয়—শোনা হয় একজন মানুষের যন্ত্রণা, মর্যাদা আর বেঁচে থাকার লড়াই হিসেবে।
আমরা চাই, মুরাদনগরের সেই নারী একদিন মাথা উঁচু করে সমাজে ফিরুন। তাঁর সন্তানের চোখে তিনি হোক সাহসের প্রতীক। আর আমরা চাই, এমন এক সমাজ—যেখানে এমন ঘটনা শুধু শিরোনাম নয়, চেতনার ঝাঁকুনি হয়ে দাঁড়াবে।
এই সমাজ বদলের সূচনা আমাদের থেকেই হতে হবে—কলম দিয়ে, কণ্ঠ দিয়ে, সচেতনতা দিয়ে। নীরবতা আর নয়—এবার প্রতিবাদের ভাষায় মানবিকতার স্বর জাগুক।
লেখক: ভাস্কর মজুমদার: পুরাতন চৌধুরী পাড়া, কুমিল্লা।
মহাব্যবস্থাপক ব্র্যাক আড়ং এবং সাবেক শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
কখনো ভোররাতে, কখনো নিঃসঙ্গ দুপুরে—একটি ঘরের জানালা দিয়ে ঢুকে পড়ে ভয়। কখনো শ্বাসরোধ করে, কখনো মুখ চাপা দেয়, কখনো আবার তার চেয়েও ভয়ংকর কিছু করে—স্মৃতি থেকে সম্মান পর্যন্ত ছিনিয়ে নেয়। বাংলাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতা আজ যেন হাওয়া, বাতাসের মতোই সর্বত্র ছড়িয়ে আছে—দেখা যায় না, কিন্তু প্রতিটি মেয়ের শ্বাসে তার ভার টের পাওয়া যায়।
কুমিল্লার মুরাদনগরের পাঁচকিত্তা গ্রামে ঘটে যাওয়া সাম্প্রতিক একটি ঘটনা আমাদের সমাজের বিবেককে এমন এক আয়নায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, যেখানে আমরা নিজের মুখ দেখতে ভয় পাই। একজন নারী, যিনি প্রবাসী স্বামীর অনুপস্থিতিতে সন্তানসহ বাবার বাড়িতে অবস্থান করছিলেন—রাতের আঁধারে নিজ ঘরে এক প্রতিবেশীর হাতে ধর্ষণের শিকার হন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তার নিপীড়নের যাত্রা সেখানেই থেমে থাকেনি।
ঘটনার পরপরই কিছু মানুষ সেই নারীর সামনে দাঁড়িয়ে তদন্তকারীর ভান করে, নানা প্রশ্নবানে তাকে জর্জরিত করে, তাকে আক্রমণ করে এবং তার কান্না ও অসহায়ত্বকে ভিডিও করে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়। এই ভিডিওগুলো ভাইরাল হয়—মতামত, মজা, কৌতূহল আর ভীষণ অসংবেদনশীল মন্তব্যের জোয়ারে। কেউ কেউ চোখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলে—ুএটা নতুন কিছু না।” এই প্রতিক্রিয়া আমাদের মানবিকতার সবচেয়ে করুণ মুখ।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের ২০২৩ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, শুধু এক বছরেই ধর্ষণের ঘটনা ছিল ৪,৬২২টি। জাতিসংঘের এক জরিপ বলছে—প্রতি দুই নারীর একজন জীবনের কোনো না কোনো সময়ে শারীরিক বা যৌন সহিংসতার শিকার হন। কিন্তু এসব সংখ্যার আড়ালে ঢাকা পড়ে যায় একজন নারীর ভেতরের ভাঙন, তার সন্তানের চোখে সমাজের বিষাক্ত চেহারা।
মুরাদনগরের ঘটনাটি আমাদের দেখিয়ে দেয়—এই সমাজে ধর্ষণ কেবল শারীরিক সহিংসতা নয়, তা হয়ে উঠেছে সামাজিক অপমান ও প্রযুক্তির অপব্যবহারে দ্বিতীয়বার নিপীড়নের হাতিয়ার। কেউ তার পাশে দাঁড়ায় না, বরং প্রশ্ন তোলে তার চারিত্রিক গঠন নিয়ে। আমরা তাকে সান্ত্বনা দিই না, বরং আরও ভেঙে দিই।
ঘটনার পর অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং মামলা হয়েছে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে। কিন্তু প্রশ্ন থাকে—এই নারীর সম্মান কি ফিরবে? তার সন্তান কি আর কখনো নির্ভয়ে সমাজের দিকে তাকাতে পারবে?
এই পরিস্থিতি বদলাতে হলে দরকার কেবল আইনি পদক্ষেপ নয়, প্রয়োজন মানবিকতা-ভিত্তিক সামাজিক পরিবর্তন। আমাদের পারিবারিক শিক্ষা, মিডিয়া চর্চা, প্রযুক্তি ব্যবহার, এবং প্রতিদিনের কথোপকথনেও এমন দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে হবে—যেখানে নারীকে কেবল ভুক্তভোগী বা পণ্য নয়, একজন পূর্ণমানুষ হিসেবে দেখা হবে।
আমাদের সমাজের প্রতিটি স্তরে—পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্র ও অনলাইন প্ল্যাটফর্ম—সবখানেই নতুন করে ভাবতে হবে: আমরা কেমন সমাজ চাই? একটিবার ভাবুন, যদি ভুক্তভোগী নারী আপনার মা, বোন বা মেয়ে হতেন, তাহলে কী করতেন?
আর সবচেয়ে জরুরি হলো—আমরা যেন নারীর কণ্ঠস্বর শুনতে শিখি। যেন তাঁর কথাগুলো বিচারকের চেয়ারে বসে নয়, অথবা অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে নয়—শোনা হয় একজন মানুষের যন্ত্রণা, মর্যাদা আর বেঁচে থাকার লড়াই হিসেবে।
আমরা চাই, মুরাদনগরের সেই নারী একদিন মাথা উঁচু করে সমাজে ফিরুন। তাঁর সন্তানের চোখে তিনি হোক সাহসের প্রতীক। আর আমরা চাই, এমন এক সমাজ—যেখানে এমন ঘটনা শুধু শিরোনাম নয়, চেতনার ঝাঁকুনি হয়ে দাঁড়াবে।
এই সমাজ বদলের সূচনা আমাদের থেকেই হতে হবে—কলম দিয়ে, কণ্ঠ দিয়ে, সচেতনতা দিয়ে। নীরবতা আর নয়—এবার প্রতিবাদের ভাষায় মানবিকতার স্বর জাগুক।
লেখক: ভাস্কর মজুমদার: পুরাতন চৌধুরী পাড়া, কুমিল্লা।
মহাব্যবস্থাপক ব্র্যাক আড়ং এবং সাবেক শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়