ড. রাশেদা রওনক খান

আজকের দিনটি ক্যালেন্ডারে প্রতিবার ফিরে আসে, প্রতিবছর। কিন্তু আমার জীবনে এ যেন এক অসীম শূন্যতার প্রতিচ্ছবি। এই দিনেই তুমি আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছিলে, মা- যেন সময়ের পাতায় এক স্থির ক্ষতচিহ্ন হয়ে রয়ে গেছো চিরকাল।
তুমি শুধু একজন মা নও, তুমি ছিলে আমার পৃথিবী, আমার আশ্রয়, আমার সাহস, আমার সামনে চলার গতিপথ। তোমার কোল ছিল নিরাপত্তার শেষ ঠিকানা। তোমার মুখে বলা প্রতিটি দোয়া ছিল যেন বেঁচে থাকার এক অদৃশ্য শক্তি। আজ, সেই কোল নেই, সেই কণ্ঠস্বর নেই, দোআও নেই—আছে শুধু স্মৃতি আর হৃদয়ের গভীরে জমে থাকা অগণিত না বলা কথা, যা বলি নি কোনোদিন , ভেবেছি, আছোই তো আমার, আমাদের।
মায়ের মৃত্যু মানেই যেন জীবনের সবচেয়ে বড় ভিত্তিটা হঠাৎ করেই ভেঙে পড়া। বিশেষ করে, এমন মা, যিনি সন্তানদের কাছে আঁধারের পথে এক জ্বলন্ত প্রদীপ। যাকে ডাকলেই সব ক্লান্তি দূর হত, যার স্পর্শে ব্যথা ভুলে যেতাম, যার গায়ের ঘ্রান কোনোদিন ভুলে যায়না। সারাদিন এটা সেটা কত কিছু যে শেখাতে, নিজের জীবনেই সকল শ্রম, মেধা, শক্তি আমাদের যেমন দিয়েছো, তেমনি দিয়েছো আসে পাশের মানুষের জন্য, সমাজের জন্য, গ্রামের গরিব দুঃখীদের জন্য। সেই তুমি আজ নীরব, অথচ আমাদের চিৎকারে আজও প্রতিধ্বনি হয়- “মা...!”
অনেকেই হয়তো আমাদের তিন ভাই বোনের পড়ালেখা কিংবা এই মুহূর্তের জীবনকে একজন আদর্শ মায়ের সন্তান হিসেবে ভাবেন, বা পরিচয় করিয়ে দেন। তখন মাথা নিচু করে তোমাকে স্বরণ করি, আর কৃতজ্ঞতা জানাই। কিন্তু যা আজ আমি অনুধাবন করি, এই সন্তান লালন-পালন জগতে অনেকেই করেন, কিন্তু সত্যিকার মানুষ বানাতে পারেন কয়জন? আজকাল যেভাবে সন্তানেরা ডিজিটাল প্রভাবে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে, মানসিকভাবে নিজস্বতা হারাচ্ছে, কাছে থেকেও পরিবার হীন, সঙ্গীহীন, নিঃস্ব ভাবছে- তুমি থাকলে কি হতো কে জানে! কিন্তু আবার এটাও জানি, মনে বিশ্বাস যে, এই ডিভাইস কেনো পুরো পৃথিবী এসে টেনে নিতে চাইলেও আমরা তোমার কাছেই শান্তি পেতাম। পৃথিবীর কোনো শক্তিই আসলে আমাদের মাঝে কোনো টান অনুভব করতে পারতো না- সম্ভবত, এটাই তোমার মা হিসেবে সার্থকতা, আর আমাদের সন্তান হিসেবে অলৌকিক প্রাপ্তি। আমরা এখন মা হিসেবে সেই টান তৈরী করতে হয়তো ব্যর্থ, তাই বাচ্চারা সব ছুটছে ডিভাইসের নেশায়, কেউ কেউ করছে সমাজে যত অকল্যাণকর কাজ।
তুমি সবসময় আমাদের শিখিয়েছো কিভাবে ভালো মানুষ হতে হয়। তোমার আদর্শ, তোমার ত্যাগ, তোমার ভালোবাসা আমাদের বেঁচে থাকার ভিত গড়ে দিয়েছে। তোমার এই টান তৈরীর কৌশল তা কেন যে রপ্ত করতে পারিনা, কিভাবে যে এমন এক টান তৈরী করে গেছো যে, প্রতিটি কাজে তোমায় মনে পড়ে। ভাবি, এই বুঝি তুমি এলে, এই বুঝি আমায় ডেকে বললে কিছু, এই বুঝি কারও জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে নির্দেশ দিলে। কুচিন্তা, কুকাজ, কুকথা, পরশ্রীকাতরতা, কুপরামর্শ দেয়ার অভ্যাস তোমার নিজেরও ছিলোনা, আমাদেরকেও এসবে নিরুৎসাহিত করেছিলে সব সময়। চেষ্টা করি এখনো মা তোমার দেয়া শিক্ষা মাথায় রাখতে। তুমি মা, তুমি হয়তো এখন কোনো এক অনন্ত জগতে শান্তিতে আছো, কিন্তু তোমার সন্তানের হৃদয়ে তুমি প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে বেঁচে আছো।
আজ তোমার মৃত্যু দিবসে, আমি কেবল তোমাকে স্মরণ করছি না, আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি- একটি সুন্দর জীবনের জন্য, তোমার সীমাহীন ভালোবাসার জন্য।
পাঠকগণ, অনুরোধ করছি আমার মায়ের জন্য দোআ করবেন। আজ এই দিনে আমি এমন একজন মায়ের জন্য দোআ চাই, যিনি ছিলেন আমার কাছে পৃথিবীর চেয়েও অনেক বড়, অনেক গভীর—একটি সম্পূর্ণ মহাবিশ্ব। তুমি চলে যাবার পর থেকে বুঝলাম, তুমি ছাড়া আমার পৃথিবী শূন্য, তাই তোমার যাত্রা পথের দিকে চোখ, অনন্ত মহাযাত্রার এই মিছিলে একদিন আমিও আমার মেয়ে কে ছেড়ে চলে যাবো। সেদিন কি আমার মেয়েও এভাবেই আমার জন্য শূন্যতায় নিমজ্জিত হবে? আমার টান অনুভব করবে? এই মা হওয়া তো এক অনন্ত সাধনার ব্যাপার! এই যুগে সন্তানকে সঠিকভাবে গড়ে তোলার মতো এমন সাধনা কয়জন মা করতে পারে!
শুনো মা, তুমি ছাড়া আমার এই জীবন অপূর্ণ।
তুমি ছিলে, আছো, আর থাকবে—আমাদের প্রতিটি নিঃশ্বাসে।
ড. রাশেদা রওনক খান: অধ্যাপক জোহরা আনিসের ছোট মেয়ে ও সহযোগী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

আজকের দিনটি ক্যালেন্ডারে প্রতিবার ফিরে আসে, প্রতিবছর। কিন্তু আমার জীবনে এ যেন এক অসীম শূন্যতার প্রতিচ্ছবি। এই দিনেই তুমি আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছিলে, মা- যেন সময়ের পাতায় এক স্থির ক্ষতচিহ্ন হয়ে রয়ে গেছো চিরকাল।
তুমি শুধু একজন মা নও, তুমি ছিলে আমার পৃথিবী, আমার আশ্রয়, আমার সাহস, আমার সামনে চলার গতিপথ। তোমার কোল ছিল নিরাপত্তার শেষ ঠিকানা। তোমার মুখে বলা প্রতিটি দোয়া ছিল যেন বেঁচে থাকার এক অদৃশ্য শক্তি। আজ, সেই কোল নেই, সেই কণ্ঠস্বর নেই, দোআও নেই—আছে শুধু স্মৃতি আর হৃদয়ের গভীরে জমে থাকা অগণিত না বলা কথা, যা বলি নি কোনোদিন , ভেবেছি, আছোই তো আমার, আমাদের।
মায়ের মৃত্যু মানেই যেন জীবনের সবচেয়ে বড় ভিত্তিটা হঠাৎ করেই ভেঙে পড়া। বিশেষ করে, এমন মা, যিনি সন্তানদের কাছে আঁধারের পথে এক জ্বলন্ত প্রদীপ। যাকে ডাকলেই সব ক্লান্তি দূর হত, যার স্পর্শে ব্যথা ভুলে যেতাম, যার গায়ের ঘ্রান কোনোদিন ভুলে যায়না। সারাদিন এটা সেটা কত কিছু যে শেখাতে, নিজের জীবনেই সকল শ্রম, মেধা, শক্তি আমাদের যেমন দিয়েছো, তেমনি দিয়েছো আসে পাশের মানুষের জন্য, সমাজের জন্য, গ্রামের গরিব দুঃখীদের জন্য। সেই তুমি আজ নীরব, অথচ আমাদের চিৎকারে আজও প্রতিধ্বনি হয়- “মা...!”
অনেকেই হয়তো আমাদের তিন ভাই বোনের পড়ালেখা কিংবা এই মুহূর্তের জীবনকে একজন আদর্শ মায়ের সন্তান হিসেবে ভাবেন, বা পরিচয় করিয়ে দেন। তখন মাথা নিচু করে তোমাকে স্বরণ করি, আর কৃতজ্ঞতা জানাই। কিন্তু যা আজ আমি অনুধাবন করি, এই সন্তান লালন-পালন জগতে অনেকেই করেন, কিন্তু সত্যিকার মানুষ বানাতে পারেন কয়জন? আজকাল যেভাবে সন্তানেরা ডিজিটাল প্রভাবে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে, মানসিকভাবে নিজস্বতা হারাচ্ছে, কাছে থেকেও পরিবার হীন, সঙ্গীহীন, নিঃস্ব ভাবছে- তুমি থাকলে কি হতো কে জানে! কিন্তু আবার এটাও জানি, মনে বিশ্বাস যে, এই ডিভাইস কেনো পুরো পৃথিবী এসে টেনে নিতে চাইলেও আমরা তোমার কাছেই শান্তি পেতাম। পৃথিবীর কোনো শক্তিই আসলে আমাদের মাঝে কোনো টান অনুভব করতে পারতো না- সম্ভবত, এটাই তোমার মা হিসেবে সার্থকতা, আর আমাদের সন্তান হিসেবে অলৌকিক প্রাপ্তি। আমরা এখন মা হিসেবে সেই টান তৈরী করতে হয়তো ব্যর্থ, তাই বাচ্চারা সব ছুটছে ডিভাইসের নেশায়, কেউ কেউ করছে সমাজে যত অকল্যাণকর কাজ।
তুমি সবসময় আমাদের শিখিয়েছো কিভাবে ভালো মানুষ হতে হয়। তোমার আদর্শ, তোমার ত্যাগ, তোমার ভালোবাসা আমাদের বেঁচে থাকার ভিত গড়ে দিয়েছে। তোমার এই টান তৈরীর কৌশল তা কেন যে রপ্ত করতে পারিনা, কিভাবে যে এমন এক টান তৈরী করে গেছো যে, প্রতিটি কাজে তোমায় মনে পড়ে। ভাবি, এই বুঝি তুমি এলে, এই বুঝি আমায় ডেকে বললে কিছু, এই বুঝি কারও জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে নির্দেশ দিলে। কুচিন্তা, কুকাজ, কুকথা, পরশ্রীকাতরতা, কুপরামর্শ দেয়ার অভ্যাস তোমার নিজেরও ছিলোনা, আমাদেরকেও এসবে নিরুৎসাহিত করেছিলে সব সময়। চেষ্টা করি এখনো মা তোমার দেয়া শিক্ষা মাথায় রাখতে। তুমি মা, তুমি হয়তো এখন কোনো এক অনন্ত জগতে শান্তিতে আছো, কিন্তু তোমার সন্তানের হৃদয়ে তুমি প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে বেঁচে আছো।
আজ তোমার মৃত্যু দিবসে, আমি কেবল তোমাকে স্মরণ করছি না, আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি- একটি সুন্দর জীবনের জন্য, তোমার সীমাহীন ভালোবাসার জন্য।
পাঠকগণ, অনুরোধ করছি আমার মায়ের জন্য দোআ করবেন। আজ এই দিনে আমি এমন একজন মায়ের জন্য দোআ চাই, যিনি ছিলেন আমার কাছে পৃথিবীর চেয়েও অনেক বড়, অনেক গভীর—একটি সম্পূর্ণ মহাবিশ্ব। তুমি চলে যাবার পর থেকে বুঝলাম, তুমি ছাড়া আমার পৃথিবী শূন্য, তাই তোমার যাত্রা পথের দিকে চোখ, অনন্ত মহাযাত্রার এই মিছিলে একদিন আমিও আমার মেয়ে কে ছেড়ে চলে যাবো। সেদিন কি আমার মেয়েও এভাবেই আমার জন্য শূন্যতায় নিমজ্জিত হবে? আমার টান অনুভব করবে? এই মা হওয়া তো এক অনন্ত সাধনার ব্যাপার! এই যুগে সন্তানকে সঠিকভাবে গড়ে তোলার মতো এমন সাধনা কয়জন মা করতে পারে!
শুনো মা, তুমি ছাড়া আমার এই জীবন অপূর্ণ।
তুমি ছিলে, আছো, আর থাকবে—আমাদের প্রতিটি নিঃশ্বাসে।
ড. রাশেদা রওনক খান: অধ্যাপক জোহরা আনিসের ছোট মেয়ে ও সহযোগী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।